১৯৭১: বধ্যভূমি ফরিদপুর স্টেডিয়াম

ফরিদপুরে শেখ জামাল স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশে একাত্তরের গণকবর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে জেলা পরিষদ। ছবি: স্টার

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ফরিদপুর স্টেডিয়ামে (বর্তমানে শেখ জামাল স্টেডিয়াম) তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিকামী তরুণদের ধরে এনে সেখানে আটকে রাখা হতো, নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। নারীদের ওপর চালানো হতো পাশবিক নির্যাতন। যাদের অনেককে পরবর্তীতে হত্যা করা হয়েছিল।

ঠিক কতজনকে এ স্টেডিয়ামের পূর্বপাশের পুকুর পাড়ে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয় তার কোন সংখ্যা এখনও জানা যায়নি। বিজয় লাভের কয়েকদিন পর ওই বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল।

১৯৯১ সালে মুক্তিযোদ্ধা ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি নূর মোহাম্মদ বাবুল গণকবরের জায়গাটি চিহ্নিত করে ছোট আকারের একটি সৌধ নির্মাণ করেছিলেন।

২০১৮ সালে সেখানে বড় পরিসরে স্মৃতির মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নির্মাণকাজ এখনও চলছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারের হাতে আটক হয়ে স্টেডিয়ামে নির্যাতনের শিকার হন জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, '১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ১৬ বছর। রাজাকাররা আমাকে ধরে নিয়ে যায়। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচি বানচাল করার জন্য ফরিদপুর কোতয়ালী থানা, পুলিশ লাইনস ও ঝিলটুলী পানির ট্যাংকের মধ্যে গ্রেনেড বিস্ফোরণ করা হয় ১৩ আগস্ট রাতে।'

ওই ঘটনায় জড়িত থাকায় সৈয়দ মাসুদসহ পাঁচ কিশোর-তরুণকে আটক করে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছিল বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।

সে সময়ের বিবরণ দিয়ে সৈয়দ মাসুদ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে নির্যাতন করা ছিল খেলার মতো। যখন যে আর্মি অফিসার আসতেন তিনিই পেটাতেন। ওই সময় কয়েকজন জেলেকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাদের স্টেডিয়ামের পাশে পাম গাছে উঠতে বলা হয়। তা না পারায় তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছিল।

তিনি আরও জানিয়েছেন, কাউকে হত্যা করতে হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে পিঠ মোড়া করে বেঁধে গাড়িতে করে বাখুন্ডা সেতুর নিচে নিয়ে গিয়ে গুলি করে কুমার নদে ফেলে দিত।

তার সামনেই ২১ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি আরও জানিয়েছেন, তারা আর ফিরে আসেননি।

স্টেডিয়ামে নির্যাতন ও নৃশংসতায় যারা মারা যেতেন, তাদের মরদেহ ওই স্টেডিয়ামের পাশে পুকুর পাড়ে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হতো বলেও জানিয়েছেন সৈয়দ মাসুদ হোসেন।

গণকবরের জায়গায় প্রথম স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা নূর মোহাম্মদ বাবুল ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'স্টেডিয়ামের পুকুর পাড়ে গণকবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম ১৯৯১ সালে। ওই সময় মাটি খুঁড়ে মাথার খুলি, নারীদের শাখা, চুল, চুড়িসহ কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল।'

সেগুলো এক জায়গায় জড়ো করে কবর দিয়ে তার ওপর একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ১৯৯১ সালের ২৬ মার্চ সাবেক সংসদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ভাষা সৈনিক ইমাম উদ্দিম আহমাদ ওই স্মৃতিসৌধ উদ্ধোধন করেছিলেন।

২০১৮ সালে গণকবরটি সংস্কারের কাজ শুরু হয়। লেক, স্তম্ভ, দুটি কালভার্টসহ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রায় ৭ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ কাজটি বর্তমানে চলমান আছে।

ফরিদপুর জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'জেলা প্রশাসকের বাসভবন ও জেলা জজের বাসভবন থেকে শুরু করে ফরিদপুর স্টেডিয়ামের সংলগ্ন এলাকায় এ নির্মাণ কাজ চলছে।'

স্মৃতিস্তম্ভটির নকশা করেছেন ফরিদপুরের চিত্রশিল্পী এজাজ এ কবির। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'যত দ্রুত সম্ভব ফরিদপুরের কেন্দ্রীয় এ গণকবরের সংস্কার কাজ সমাপ্ত করা হবে।'

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, এই গণকবর ছাড়া ফরিদপুর জেলায় আরও কয়েকটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি নগরকান্দা-চাঁদহাট সড়কের পশ্চিম পাশে কোদালীয়া শহীন নগর গ্রামের বধ্যভূমি।

এছাড়াও, ফরিদপুরের ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের বাবু বাড়ি হিসেবে পরিচিত বাড়িতে একটি বধ্যভূমি রয়েছে। সেখানে ১৯৭১ সালের ২ মে ২৮ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।

গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল ফরিদপুরের কানাইপুর জমিদার বাড়িতেও। তবে লাশ খুঁজে না পাওয়ায় সেখানে কোন বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়নি বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। ভাঙ্গা উপজেলার তুজারপুর ইউনিয়নে জান্দি গ্রামেও বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে বলেও তারা জানিয়েছেন।

Comments

The Daily Star  | English
rooppur-nuclear-power-plant

Power division gets 30% lower budget allocation

The allocation for the power division in the national budget for fiscal year 2025-26 is around 30 percent less than that of the previous fiscal year, while it has been nearly doubled for the energy and mineral resources division. .The government has decided to cut electricity production c

3h ago