শেষ ওভারের রোমাঞ্চে চ্যাম্পিয়ন খুলনা
অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে প্রতিপক্ষের বোলিং তোপ সামলে জেমকন খুলনাকে লড়াইয়ের পুঁজি এনে দিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। জবাবে শুরুর শামুক গতির ব্যাটিংয়ের খোলস ভেঙে পরে চালিয়ে খেলা সৈকত আলীর ফিফটিতে লক্ষ্য স্পর্শ করার সম্ভাবনা জাগাল চট্টগ্রাম। কিন্তু তরুণ পেসার শহিদুল ইসলাম শেষ ওভারে করলেন নজরকাড়া বোলিং। সৈকতকে ফেরানোর পাশাপাশি নিলেন ২ উইকেট। তাতে ৬ বলে ১৬ রানের সমীকরণ মেলানো হলো না চট্টগ্রামের। রোমাঞ্চকর জয়ে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের শিরোপা জয়ের উল্লাসে মাতল খুলনা।
শুক্রবার মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে আসরের ফাইনালে শেষ ওভারের নাটকীয়তায় ৫ রানে জিতেছে মাহমুদউল্লাহর খুলনা। ১৫৬ রানের লক্ষ্য তাড়ায় মোহাম্মদ মিঠুনের চট্টগ্রাম থামে ৬ উইকেটে ১৫০ রানে।
ম্যাচের শেষ ওভারে উইকেটে ছিলেন থিতু হয়ে যাওয়া দুই ব্যাটসম্যান সৈকত ও মোসাদ্দেক হোসেন। প্রথম দুই বলে আসে ৩ রান। তৃতীয় বলটি ছিল স্লোয়ার ফুলটস। মোসাদ্দেক কাজে লাগাতে পারেননি। ক্যাচ দেন লং অনে শুভাগত হোমের হাতে। তাতে হালে পানি পেয়ে যায় খুলনা। পরের বলে সৈকতকেও বোল্ড করে ম্যাচের ভাগ্য নিজেদের দিকে টেনে নেন শহিদুল। লড়াই সুপার ওভারে নিতে চট্টগ্রামের দরকার ছিল ২ ছক্কা। কিন্তু পঞ্চম বলে আসে মোটে ১ রান। নিশ্চিত হয়ে যায় খুলনার চ্যাম্পিয়ন হওয়া। নাহিদুল ইসলামের শেষ বলের ছক্কা তাই কেবল ব্যবধানই কমায়।
পুরো আসরে অধিকাংশ ম্যাচে চট্টগ্রামকে ভালো শুরু পাইয়ে দেন লিটন দাস ও সৌম্য সরকার। এ ম্যাচেও লক্ষ্য তাড়ায় তেমন কিছুর ইঙ্গিত মিলেছিল। কিন্তু তাদের সাবধানী সূচনার ইতি ঘটে চতুর্থ ওভারে।
স্পিনার শুভাগতর সোজা বল বলে ধোঁকা খান সৌম্য। ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে বল আঘাত করে স্টাম্পে। দুই বল আগে ইমরুল কায়েস সহজ ক্যাচ মিস করায় বেঁচে যাওয়া এই বাঁহাতি ফেরেন ১০ বলে ১২ রান করে। তাতে ভাঙে ২৬ রানের জুটি।
পরের ওভারে বল হাতে নিয়েই মিঠুনকে এলবিডাব্লিউয়ের ফাঁদে ফেলেন আল-আমিন হোসেন। এরপর স্লগ করার চিন্তা থেকেই হয়তো চারে নামানো হয় সৈকতকে। প্রথম কয়েক বল ব্যাটে লাগাতে না পেরে উল্টো চাপ বাড়িয়ে দেন তিনি। ঝুঁকি নিয়ে রান নিতে গিয়ে সেই চাপেই রান আউটে কাটা পড়েন লিটনও। আসরের সর্বোচ্চ রান (৩৯৩) করা ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে তখন চট্টগ্রাম হতভম্ব।
পাওয়ার প্লেতে ২ উইকেট হারিয়ে মাত্র ৩৯ রান তোলা দলটি ৫১ রানের মাথায় ৩ উইকেট হারিয়ে পড়ে ভীষণ চাপে। ২৩ বলে ২ চারে ২৩ রান করে বিদায় নেন লিটন। ডট বলে তার সঙ্গী সৈকত বাড়াচ্ছিলেন চাপ। ফলে স্বাভাবিক খেলা খেলতে ধুঁকতে হচ্ছিল লিটনকে।
শহিদুলের বল আলতো করে ঠেলে রানের জন্য দৌড় দেন সৈকত। লিটনও দেন সাড়া। তবে দারুণ দক্ষতায় বল হাতে জমিয়ে সরাসরি থ্রোতে স্টাম্প ভেঙে দেন শহিদুল নিজেই।
এরপর ৩৪ বলে ৪৫ রানের একটি ভালো জুটি গড়েন সৈকত ও শামসুর রহমান শুভ। এক-দুই করে রান বাড়ানোর পাশাপাশি প্রায় প্রতি ওভারেই বাউন্ডারি আদায় করে নেন তারা। ফলে লড়াইয়ে ফেরে দলটি।
এই জুটি ভেঙে খুলনাকে গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক-থ্রু এনে দেন পেসার হাসান মাহমুদ। লং অনে ২১ বলে ২৩ রান করা শামসুরের ক্যাচ নেন শুভাগত। ১৬তম ওভারে শতরান স্পর্শ করে চট্টগ্রামের স্কোর।
শেষ ৫ ওভারে জয়ের জন্য দলটির দরকার দাঁড়ায় ৫৭ রান। সৈকত আর মোসাদ্দেকের পঞ্চম উইকেট জুটিতে এই হিসাবনিকাশ প্রায় মিলিয়েই ফেলেছিল তারা। তারা যোগ করেন ৩১ বলে ৪৭ রান। কিন্তু তীরের কাছে গিয়ে তরী ডোবে চট্টগ্রামের।
৩৮ রানে জীবন পাওয়া সৈকত দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫৩ রান করেন ৪৫ বলে। তার ইনিংসে ছিল ৪ ছক্কা। মোসাদ্দেক ১৪ বলে করেন ১৯ রান। শহিদুল ২ উইকেট নেন ৩৩ রানে। উইকেটের স্বাদ পান শুভাগত, আল-আমিন আর হাসানও। মাশরাফি বিন মর্তুজা খরুচে বোলিংয়ে ৪০ রান দিয়ে থাকেন উইকেটশূন্য।
এর আগে টস জিতে সাকিব আল হাসানবিহীন খুলনাকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান চট্টগ্রামের অধিনায়ক মিঠুন। নির্ধারিত ২০ ওভারে দলটি ৭ উইকেটে তোলে ১৫৫ রান।
ক্যাপ্টেনস নক খেলে মাহমুদউল্লাহ অপরাজিত থাকেন ৪৮ বলে ৭০ রানে। তার ইনিংসে ছিল ৮ চার ও ২ ছক্কা। সৌম্য সরকারের শেষ ওভারে ছয়গুলো মারেন তিনি। ওই ওভারে আসে ১৭ রান। ফলে খুলনার স্কোর পেরিয়ে যায় দেড়শো।
অষ্টম ওভারে ব্যক্তিগত ৮ রানে রিভিউ নিয়ে জীবন পান মাহমুদউল্লাহ। শিরোপা নির্ধারণী মঞ্চে পাঁচে নেমে ব্যাটিং করেন ইনিংসের শেষ পর্যন্ত। চাপের মুখে একপ্রান্ত আগলে প্রতিরোধ গড়েন। এরপর একদম শেষে তোলেন ঝড়।
প্রথম বলেই প্রতিপক্ষের ইনিংসে আঘাত করেন নাহিদুল ইসলাম। উড়িয়ে মারতে গিয়ে ব্যাটে-বলে ঠিকঠাক সংযোগ করতে পারেননি জহুরুল ইসলাম। মিড অফ থেকে পেছনের দিকে দৌড়ে ক্যাচ নেন মোসাদ্দেক হোসেন।
নিজের পরের ওভারে তিনে নামা ইমরুল কায়েসকেও দ্রুত বিদায় করেন অফ স্পিনার নাহিদুল। তিনিও টাইমিংয়ের গড়বড়ে ফেরেন সাজঘরে। খুলনাকে আরও চেপে ধরে সুযোগ এরপর হাতছাড়া করে চট্টগ্রাম। চতুর্থ ওভারে ওপেনার জাকির হোসেনের কঠিন ক্যাচ ডাইভ দিয়েও হাতে জমাতে পারেননি মিঠুন।
পাওয়ার প্লের বাকি সময়টা নির্বিঘ্নে পার করেন জাকির ও আরিফুল হক। ৬ ওভার শেষে তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২ উইকেটে ৪২ রান।
সপ্তম ওভারে আক্রমণে গিয়েই উইকেট উৎসবে যোগ দেন মোসাদ্দেক। ১২ রানে জীবন পাওয়া জাকিরকে বদলি ফিল্ডার মাহমুদুল হাসান জয়ের ক্যাচে পরিণত করেন তিনি। ২০ বলে ৩ চার ও ১ ছয়ে তিনি করেন ২৫ রান।
৪৩ রানে ৩ উইকেট খুইয়ে বিপাকে পড়া খুলনার ইনিংস মেরামতের কাজে লাগেন আরিফুল ও মাহমুদউল্লাহ। সিঙ্গেল-ডাবলস নিয়ে এগোতে থাকেন তারা। মাহমুদউল্লাহ হাত খোলেন একাদশ ওভারে। মোসাদ্দেককে টানা মারেন ছয় ও চার।
৩২ বলে ৪০ রানের এই জুটি ভাঙেন দ্বিতীয় স্পেলে ফেরা বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলাম। ধীরগতির ব্যাটিংয়ে ২৩ বলে ২১ রান করে উইকেটরক্ষক লিটন দাসের তালুবন্দি হন আরিফুল। লোয়ার অর্ডার থেকে উঠিয়ে তাকে চারে নামানোর বাজি তাই ফলেনি।
খুলনার স্কোর তিন অঙ্কে পৌঁছায় ১৪তম ওভারের শেষ বলে। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে বল মোস্তাফিজের ডেলিভারি সীমানাছাড়া করেন বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলনেতা মাহমুদউল্লাহ।
হাতে রয়েছে উইকেট। ঝড় তোলার উপযুক্ত পরিস্থিতি। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে যার অনেক আগ্রাসী ইনিংস আছে, সেই শুভাগত হোম করেন হতাশ। ১২ বলে ১৫ রান করে আউট হন তিনি। শরিফুলের শর্ট ডেলিভারিতে টপ এজ হয়ে আকাশে উঠে যাওয়া বল লং লেগে লুফে নেন মোস্তাফিজ।
শামিম পাটোয়ারি ভুল বোঝাবুঝিতে প্রথম বলেই হন রানআউট। এরপর মাশরাফি বিন মর্তুজাকে ফিরিয়ে আসরে খেলা ১০ ম্যাচের সবকটিতে উইকেট পাওয়ার কীর্তি গড়েন মোস্তাফিজুর রহমান। সবমিলিয়ে এই বাঁহাতি গতি তারকার শিকার টি-টোয়েন্টি কাপের সর্বোচ্চ ২২ উইকেট।
মাহমুদউল্লাহর আগ্রাসনে শেষ ৩ ওভারে ৩৫ রান তোলে খুলনা। চট্টগ্রামের হয়ে নাহিদুল ১৯ ও শরিফুল ৩৩ রানে নেন ২ উইকেট। মোস্তাফিজ ২৪ রানে পান ১ উইকেট। মোসাদ্দেকের শিকারও ১ উইকেট।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
জেমকন খুলনা: ২০ ওভারে ১৫৫/৭ (জহুরুল ০,জাকির ২৫, ইমরুল ৮, আরিফুল ২১, মাহমুদউল্লাহ ৭০*, শুভাগত ১৫, শামিম ০, মাশরাফি ৫, শহিদুল ১*; নাহিদুল ২/১৯, শরিফুল ২/৩৩, রাকিবুল ০/১৯, মোসাদ্দেক ১/২০, মোস্তাফিজ ১/২৪, সৌম্য ০/৩৯)
গাজী গ্রুপ চট্টগ্রাম: ওভারে (লিটন ২৩, সৌম্য ১২ , মিঠুন ৭, সৈকত ৫৩, শামসুর ২৩, মোসাদ্দেক ১৯, নাহিদুল ৬, নাদিফ ১; মাশরাফি ০/৪০, শুভাগত ১/৮, আল-আমিন ১/১৯, হাসান ১/৩০, আরিফুল ০/১৮, শহিদুল ২/৩৩)।
ফল: জেমকন খুলনা ৫ রানে জয়ী।
ম্যাচসেরা: মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
Comments