কুমিল্লা টাউন হলকে প্রত্নসম্পদ ঘোষণায় গণশুনানি
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কুমিল্লা টাউন হলকে প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা করবে কি না, সে বিষয়ে আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১১টায় টাউন হল প্রাঙ্গণে গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে।
কুমিল্লা টাউন হল নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বিষয়টি দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুল মান্নান ইলিয়াস গত ৯ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলা প্রশাসনে অনুষ্ঠিত সভায় এই গণশুনানি আয়োজনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন।
সেসময় টাউন হল ভবনের জরাজীর্ণ অবস্থার কথা উল্লেখ করেন তিনি। টাউন হল ভেঙে পুনর্নির্মাণের বিরোধিতাকারী ৫০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের তালিকা সংগ্রহ করে তাদের মতামত নেওয়া এবং টাউন হলকে কেন প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হবে না, সেজন্য এই গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
১৯৩৩ সালে কুমিল্লা টাউন হলের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৩৫ সালে শেষ হয় বলে জেলা প্রশাসনের ওই সভায় উল্লেখ করা হয়।
তবে, ১৮৮৫ সালে কুমিল্লা বা তৎকালীন ত্রিপুরার কালেক্টর জেএফ স্ক্রাইনের উদ্যোগে ত্রিপুরা মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর কর্তৃক স্থাপিত টাউন হল যে ব্রিটিশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে শুরু করে কুমিল্লা তথা বাংলাদেশ অবধি শিল্প সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র, শতবর্ষী পুরাতন ভবনের অনেক অকাট্য দলিলপত্র ও তথ্যপ্রমাণ থাকার পরেও কেন তা নিয়ে গণশুনানির আয়োজন হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
দেশবরেণ্য প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ আ ক ম যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মোবাশ্বের আলীর সম্পাদনায় ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ‘কুমিল্লা জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সহচর সুলতান মাহমুদ মজুমদারের লেখা ‘মঞ্চ শিল্প ও নাটক’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু মহারাজ রাধা কিশোর মাণিক্য বাহাদুর টাউন হলের পশ্চিম অংশের মিলনায়তনের স্থায়ী মঞ্চটি তৈরি করেন। একে কেন্দ্র করেই ১৯০৮ সালে উপমহাদেশের বিখ্যাত নাট্যদল ভার্নাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রবোধ চন্দ্র রায়।
কালের সাক্ষী এই টাউন হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শের এ বাংলা একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ বহু গুণীজন পদধুলি দিয়েছেন।
কেবল এ ভবনটিই নয়, এতে থিওসোফিকেল সোসাইটি, কুমিল্লা ক্লাব ও মিনিস্ট্রিয়াল ক্লাব যথাক্রমে ১৮৮৯, ১৯১৭ ও ১৯২০ সালে স্থাপিত হয়েছে। এসব সংগঠনের সবগুলোই শতবর্ষী।
এ ছাড়াও, কুমিল্লা সদরের সংসদ সদস্য হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মালিকানাধীন একটি চারতলা মার্কেট এই টাউন হল প্রাঙ্গণেই নির্মিত।
ইতোপূর্বে সংসদ সদস্যের উদ্যোগে গণপূর্ত বিভাগ কর্তৃক টাউন হলের বহুতল মাল্টিপারপাস ভবনের নকশা প্রস্তাবনা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এরপর থেকেই বিষয়টি সংস্কৃতি কর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়।
এ বিষয়ে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য আঞ্জুম সুলতানা সীমা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ফায়দার জন্য সদর আসনের সংসদ সদস্য টাউন হল ভেঙে ফেলতে চাইছেন। ইতোপূর্বে তিনি টাউন হলে মার্কেট নির্মাণ করে দোকানের পজিশন বিক্রি করেছেন। টাউন হল পরিচালনা কমিটি হচ্ছে স্থানীয় সংসদ সদস্যের অধীন।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান কাঠামো ঠিক রেখেই টাউন হলের সংস্কার করা যেতে পারে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চাইলে কোন শুনানি ছাড়াই টাউন হলকে প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে।’
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক ডা. আতাউর রহমান জানান, গণশুনানি ও টাউন হলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।
ঐতিহ্যবাহী এই টাউন হল ভাঙার বিরোধিতা করেছেন প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ। তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে ইমেইল করেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য সরকার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কুমিল্লা টাউন হল তথা বীরচন্দ্র গণপাঠাগারকে কাঠামো ঠিক রেখে যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ জানিয়েছে। এ ছাড়াও, সামাজিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় সাতকথা নামের পশ্চিম ত্রিপুরার একটি সংগঠনও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে টাউন হলের কাঠামো ঠিক রেখে সংরক্ষণের অনুরোধ জানিয়েছে।
এদিকে, কুমিল্লা টাউন হল ভেঙে পুনর্নির্মাণের জন্য কুমিল্লা সদর আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলো আগামীকাল শহরে মানববন্ধন করবে বলে নিশ্চিত করেছেন সংসদ সদস্যের আস্থাভাজন ও কুমিল্লা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তারিকুর রহমান জুয়েল।
Comments