‘এটা বর্ডার কিলিং না, এটা কিলিং ইনসাইড ইন্ডিয়া’

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ-ভারত ভার্চুয়াল সামিটে আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের ব্যস্ত সময় কেটেছে সারাদিন। ছিলেন মানসিকভাবে উৎফুল্ল। ফোন করেই তার প্রমাণ মিলল।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। ফাইল ছবি

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ-ভারত ভার্চুয়াল সামিটে আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের ব্যস্ত সময় কেটেছে সারাদিন। ছিলেন মানসিকভাবে উৎফুল্ল। ফোন করেই তার প্রমাণ মিলল।

ফোন ধরেই বললেন, ‘আজ খুব ভালো দিন। ভারতের সঙ্গে আজ যে সম্মেলন (ভার্চুয়াল সামিট) হলো, এটা খুব আন্তরিক ছিল (ইট ওয়াজ ভেরি করডিয়াল)। অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে সম্মেলনটা হয়েছে। ইন্ডিয়ান সাইড ওয়াজ ভেরি ওয়েলকামড। আমরা অত্যন্ত খুশি (উই আর প্লিজড) এটা নিয়ে।

ডেইলি স্টার: তাহলে তো খুবই ভালো ব্যাপার। ভারত-বাংলাদেশ যেকোনো আলোচনায় ঘুরেফিরে দুটি প্রসঙ্গ আসে, তিস্তা চুক্তি আর সীমান্ত হত্যা। এই দুটি ক্ষেত্রে কোনো সুসংবাদ আছে কি না?

আব্দুল মোমেন: আপনারা জানেন তিস্তা চুক্তি কোথায় আটকে আছে। ভারত সরকার বারবার অঙ্গিকার করছে, যখন তাদের অভ্যন্তরীণ (ইন্টারনাল) সমস্যা দূর হবে, তখন এটা সই হবে। সুতরাং, আপনি বারবার এটা উচ্চারণ করে লজ্জিত করার কোনো কারণ নেই। বরং, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, মিডিয়াকে বলেন। এটার প্রতি পাতায় সই (পেজে পেজে ইনিশিয়াল) করা আছে। শুধু বাস্তবায়ন (ইমপ্লিমেন্ট) হবে। ইমপ্লিমেন্টটা হচ্ছে না। সুতরাং, আপনাদের একটা দায়িত্ব আছে। আপনারা এ নিয়ে ভারতে কিংবা পশ্চিমবঙ্গে জনমত গঠন করেন। ভারত সরকার এটা করতে রাজি। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের জনমত এর পক্ষে না থাকায়, তারা এখনও এটা করতে পারেনি।

ডেইলি স্টার: ভারতের চেষ্টা কি দৃশ্যমান?

আব্দুল মোমেন: সেটা আপনি ভারতের নেতৃবৃন্দকে জিজ্ঞাসা করেন। আমি তাদের হয়ে এর উত্তর দিতে পারব না (আই ক্যান্ট আনসার অন বিহাফ অব দেম)। তারা আমাদের অঙ্গিকার করেছে যে এটা হবে এবং আমরা তাদের ওপর আস্থা রাখতে চাই।

ডেইলি স্টার: এখানে আমরা মানে গণমাধ্যম কীভাবে সহায়তা করতে পারে বলে মনে করছেন?

আব্দুল মোমেন: আপনারা ভারতের সরকারকে জিজ্ঞাসা করেন, ভারতের নেতৃবৃন্দকে জিজ্ঞাসা করেন। আমার কাছে জিজ্ঞাসা করে কোনো লাভ নাই।

ডেইলি স্টার: সীমান্ত হত্যা বন্ধে কোনো অগ্রগতি?

আব্দুল মোমেন: আমরা তো বহুদিন ধরেই সীমান্ত হত্যা নিয়ে কথা তুলছি। ভারত সরকার আমাদের বলেছে যে সেখানে কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহার হবে না। আজকেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী আবার বলেছেন। তারাও সীমান্তে হত্যা  চায় না। তারা একটা জিনিস বলেছে, সেখানে মাঝে মাঝে অপরাধীরা (ক্রিমিনালস) গিয়ে ঝামেলা করে। যারা ক্রিমিনাল তারাও কিন্তু অস্ত্র ব্যবহার করে। সুতরাং, সেই ব্যাপারে আমাদেরও সজাগ থাকতে হবে। অপরাধীরা সেখানে বোমা নিয়ে যাবে, বন্দুক নিয়ে যাবে, বিএসএফের ওপর আক্রমণ করবে, এটা তো ঠিক না। ভারতের ভেতরে গিয়ে আক্রমণ করে। এটা বর্ডার কিলিং না। এটা ‘কিলিং ইনসাইড ইন্ডিয়া’। এটা আপনাদের দেখতে হবে। আপনারা ‘বর্ডার কিলিং’ বলে ফেলেন। কিন্তু, অনেক সময় বর্ডার থেকে বহু ভেতরে গিয়ে লোকেরা মারা যায়। সেখানে তাদের লেনদেনে ঝামেলা হয়, তখন সে মারা যায়। আপনারা মিডিয়ার লোক লেনদেনের ঝামেলা কেন হয়, সেগুলো তুলে আনেন (ইউ শুড এক্সপোজড ইট)।

ডেইলি স্টার: বিজিবি সূত্রে আমরা যে সংবাদ পাই তা থেকে তো জানা যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও মারা যায়।

আব্দুল মোমেন: বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ‘ক্রিমিনাল’ তো মারা যাবেই। খুব কম মারা যায়। দুনিয়ার সব দেশেই মারা যায়। শুধু বাংলাদেশে না। আমেরিকায় প্রতি বছর হাজারখানেক মারা যায়, এ বছর এক হাজার ৪০০ জনকে পুলিশ মেরেছে দেশের অভ্যন্তরে। শুধু পুলিশ মেরেছে। সুতরাং, বাংলাদেশে এটা আহামরি জিনিস না। আমরা কেউ চাই না একটা লোকও মারা যাক। কিন্তু, সব দেশেই মারা যায়। ইট ইজ অ্যা ফ্যাক্ট অব লাইফ। আপনি এমন দুনিয়া তৈরি করেন, যেখানে একটাও লোক মরবে না, সেটা হলে আমরা খুব খুশি হবো।

ডেইলি স্টার: ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে গুলি না করে সমাধানের কোনো উপায় কেন বের করা যাচ্ছে না?

আব্দুল মোমেন: ভারত বলছে, আত্মরক্ষার জন্য তাদের মাঝে মাঝে ক্রিমিনালদের গুলি করতে হয়। আপনিও জানেন যে, সেখানে ক্রিমিনাল আছে। তথ্য যাচাই বাছাই করেন। ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট করেন। রিপোর্টার পাঠান। দেখেন ওদের কাছে বোমা থাকে। এটা ভারতের অভিযোগ। আমি তো গিয়ে দেখিনি। আমরা ইনভেস্টিগেট করিনি।

ডেইলি স্টার: বাংলাদেশ সরকারেরও অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন।

আব্দুল মোমেন: অবশ্যই।

ডেইলি স্টার: আজকের সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সই বাংলাদেশের জন্য কী কী কারণে উপকারী হবে?

আব্দুল মোমেন: ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো বলেই, আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপকার হচ্ছে। আমাদের দেশের লোক ওই দেশে গিয়ে চিকিৎসা পাচ্ছে। আর ভারতও আমাদের দেশে বিনিয়োগ করছে। ভারতে আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। ভালো সম্পর্কের জন্যই এ সব হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে আমরা উপকৃত হচ্ছি। পিন পয়েন্ট করে বলা যাবে না। আমরা নিরাপদ বোধ করি (উই ফিল সিকিউরড)। এত বড় প্রতিবেশী, যদি তিক্ততার সম্পর্ক থাকতো, যখন তখন একটা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করতে হতো। বাংলাদেশ এখন নিরাপদ বোধ করে। আমাদের প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। ভারত আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সবসময় সাহায্য করছে। আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হওয়ায়, তারাও নিরাপদ বোধ করে। তাদের ইস্টার্ন বর্ডার নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। তারাও সন্ত্রাসীর পেছনে আছে, আমরাও সন্ত্রাসীর পেছনে আছি। এ জন্য, আমাদের এই এলাকায় সন্ত্রাসী তৎপরতা কম।

ডেইলি স্টার: রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে সর্বশেষ আলোচনা কী হয়েছে?

আব্দুল মোমেন: ভারত বলেছে, তারা আমাদের সঙ্গে একমত যে রোহিঙ্গাদেরকে তাদের স্বদেশে ফিরে যেতে হবে। এটাই সমাধান। এর জন্য যা যা করার, তারা বাংলাদেশকে সাহায্য করবে। তারা বিশ্বাস করে, রোহিঙ্গাদের স্থায়ী সমাধান হচ্ছে তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন।

ডেইলি স্টার:  জাতিসংঘে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকে, ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। যা খুব আলোচিত হয়।

আব্দুল মোমেন: এটা ভারতের কৌশল। ভারত নিরপেক্ষ ছিল, আমাদের পক্ষে ভোট দেয়নি।কৌশলের অংশ হিসেবে তারা এটা করেছে এবং আমাদের আগেই জানিয়েছে। বলেছে যে, ‘তোমাদের পক্ষে আমরা ভোট দেব না। কারণ আমরা নিরপেক্ষ  থাকতে চাই। আমাদের মিয়ানমারের বিষয়ে কিছুটা ছাড় দিতে হয়।’ এটা ভারতের কৌশল।

ডেইলি স্টার: চীন তো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের পক্ষে ভেটো দেয়।

আব্দুল মোমেন: চীন তার স্বার্থ দেখে করে। আপনি কি চীনকে জোর করে ভোট চেঞ্জ করে দেবেন? জোর করে তার কোনো পক্ষের প্রতি সমর্থন বন্ধ করে দিবেন? আমরা কি চীনকে আটকাতে পারব যে, তুমি মিয়ানমারের পক্ষে ভোট দিতে পারবে না। চীনের নিজেদের পলিসি আছে। তারা আমাদের বলেছে যে তারা আমাদের সাহায্য করছে। যথেষ্ট সাহায্য করছেও আমাদের। কিন্তু, এর মানে এই নয় যে, আমরা তাদেরকে নির্দেশনা দিতে পারব। আমরা তো কাউকে ডিকটেট করতে পারি না।

ডেইলি স্টার: রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা কোন পর্যায়ে আছে?

আব্দুল মোমেন: আমাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সর্বশেষ আলোচনা গত জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখ হয়েছে। সেখানে আমরা একটা কমিটি করেছি। আমাদের ডিজি এবং তাদের অ্যাম্বেসেডরকে নিয়ে। খুব ভালো আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় মিয়ানমার বলেছে যে রোহিঙ্গা বিষয়ে তারা একটা বুকলেট তৈরি করছে। আমরা বেশ আশাবাদী যে এগুলোর ফলাফল ভালো হবে।

ডেইলি স্টার: রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলমান থাকবে?

আব্দুল মোমেন:  অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেহেতু, অনেক রোহিঙ্গা ছোট্ট অল্প জায়গায় থাকে। মানুষ কষ্টে থাকুক, আমরা এটা চাই না। ভূমিধ্বসে বহু লোক মারা গেল। আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিলাম যে এক জায়গা থেকে কিছু লোক কমাব। আমরা রোহিঙ্গাদের জীবনের ঝুঁকি কমানোর জন্য, লাখখানেক লোককে ভাসানচরে নিয়ে যাব। তাতে, বাকিরা একটু সুখে থাকবে। স্থানীয় জনগণ এখন খুব অসন্তুষ্ট। একাধিক কারণে। এদের মধ্যে আবার দলাদলি আছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে সম্প্রতি কিছু লোক মারা গেছে। একাধিক কারণে আমরা ঠিক করেছি, ভাসানচরে সুন্দর রিসোর্টে তাদের নিয়ে রাখব।

ডেইলি স্টার: সব রোহিঙ্গাকে নিয়ে যাওয়া হবে?

আব্দুল মোমেন: আমাদের দেশে প্রায় তিন হাজার মানুষ প্রতি বর্গমাইলে থাকে। আমেরিকায় ৩৬ জন, ইউরোপে গড়ে ১৫ জন প্রতি বর্গমাইলে থাকে। ওখানে অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আছে। তাদের বলেন, তাদের দেশে তো লোকই নেই। তারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাক। আমাদের এখানে জায়গার খুব অভাব। আপনারা যদি কোনো জায়গা বের করতে পারেন, আমরা তাদের ওখানে রিলোকেট করতে পারি। আমরা সবাইকে বলেছি, কেউ যদি নিতে চান, নেন। কিন্তু, কেউ নিতে আগ্রহী না। শুধু কানাডা বলছিল নিবে। ছয়জন লোককে নিবে। এটা জোক। আপনি দেখেন, জায়গা খুঁজে বের করেন। যদি নিয়ে যেতে পারেন, তাদের যদি সুখী রাখতে পারেন, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। আমরা আপনাকে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড দেব। 

ডেইলি স্টার: বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কী, সব রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হবে? নাকি এখন যেখানে আছে সেখানেও থাকবে, ভাসানচরেও কিছু থাকবে?

আব্দুল মোমেন: এভাবে বলা যাবে না। আমরা টাইম টু টাইম চিন্তা করি। ধন্যবাদ।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh Public Administration Ministry's Logo

2 deputy commissioners among 3 transferred ahead of polls

The Ministry of Public Administration today announced transfers of at least three government officials, including two deputy commissioners, ahead of the upcoming national parliamentary election

29m ago