ফজলে হাসান আবেদ: একজন কিংবদন্তির সান্নিধ্যে
তিনি ‘মানুষের প্রেসিডেন্ট’ গরিব মানুষের ‘প্রেসিডেন্ট’।
২০০৪ সালে ‘মানব উন্নয়ন’ পুরস্কার দিতে গিয়ে একথা বলেছিলেন তৎকালীন ইউএনডিপি প্রধান। প্রবর্তনের পর এই পুরস্কার প্রথম দেওয়া হয়েছিল ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট কর্ডোসাকে। তখন থেকে মোটামুটি একটি ধারণা হয়েছিল যে, মানব উন্নয়নের এই পুরস্কার একজন রাজনীতিবিদ প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হবে। দুই বছর পর পর দেওয়া হয় এই পুরস্কার। দ্বিতীয়বার পুরস্কারের মনোনয়ন তালিকায় পৃথিবীর বহু দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর নাম ছিল। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে ইউএনডিপি প্রধান বলেছিলেন, এবছরের মনোনয়নে নাম আসা দেশগুলোর প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীদের চেয়েও তিনি মানব উন্নয়নে বেশি ও তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সেকারণে এবছর পুরস্কার পাচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট নন, তিনি ‘মানুষের প্রেসিডেন্ট’।
এই মানুষের প্রেসিডেন্টের নাম ফজলে হাসান আবেদ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা। দেখতে দেখতে বছর পেরিয়ে গেল। ২০ ডিসেম্বর তার চলে যাওয়ার দিন।
২০০৫ সালের এক শীতের ভোর। গাড়ি চলছে সিলেটের উদ্দেশে। কিছুদিন আগে মানব উন্নয়ন পুরস্কার পেয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়েছে নিউইয়র্কে। সেই পুরস্কার বিষয়ে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তরে উপরের কথাগুলো বলেছিলেন ফজলে হাসান আবেদ। ‘অনেকগুলো’ প্রশ্নের প্রসঙ্গ একারণে যে, তিনি কথা কম বলেন, নিজের সম্পর্কে বলেন আরও কম। ফলে একটি প্রসঙ্গের উত্তর পেতে কয়েকটি প্রশ্ন করতে হয়। বিশেষ করে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে।
এর আগেও তার সঙ্গে বেশ কয়েকবার এ পথে গিয়েছি। গিয়েছি মানিকগঞ্জ, উত্তরবঙ্গের বহু স্থানে। ‘ফজলে হাসান আবেদ ও ব্র্যাক’ বই লেখার জন্যে এই যাত্রা। সেই প্রসঙ্গের কিঞ্চিত বিবরণে পরে আসছি।
গাড়ি চলছে। প্রশ্নের চেয়েও উত্তর সংক্ষিপ্ত। আপনার সঙ্গে এই যে বহু জায়গায় যাওয়ার অভিজ্ঞতার সব তো বইয়ে থাকবে না। তবে এক সময় লিখব। মুখের দিকে তাকিয়ে স্বভাবসুলভ মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমি মারা যাওয়ার পরে?’
আকস্মিক এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেওয়া গেল না। কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। নরসিংদীর কাছাকাছি একটি ব্র্যাক অফিসে গাড়ি থামানো হলো। পূর্ব নির্ধারিত নয়, হঠাৎ করে। গেটে দাঁড়ানো ব্র্যাকের কর্মী হাসি মুখে সালাম দিয়ে বললেন, ভাই কেমন আছেন? অনেক দিন পরে আসলেন।
ব্র্যাকের একটি মৎস্য হ্যাচারিতে থামতেই একদল কর্মী এগিয়ে এলেন। ‘ভাই এখন অনেক কম আসেন। আগে তো প্রায়ই আসতেন।’
ব্র্যাকের বড় একটি পোল্ট্রি ফার্মের গেটে গিয়ে গাড়ি হর্ন দিল। নিরাপত্তা কর্মী পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্যে দেড় দুই মিনিট গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখলেন। চালক নেমে কথা বললেন। একজন কর্মকর্তা দৌড়ে এসে নিরাপত্তা কর্মীকে ধমক দিয়ে বললেন, ভাইয়ের গাড়ি ঢুকতে দিচ্ছ না কেন!
ঝাড়ু দিচ্ছিলেন একজন নারী কর্মী। বাম হাতে ঝাড়ু পেছনে নিয়ে এগিয়ে এলেন, ‘ভাই শরীর ভালো? আমাদের ভুলে গেছেন। এখন আর আসেন না।’
এই তিনটি ঘটনা উল্লেখ করার কারণ কয়েকটি।
ফজলে হাসান আবেদ নোবেল ছাড়া পৃথিবীর সব বড়-মর্যাদা সম্পন্ন পুরস্কার পেয়েছেন। নাইট উপাধি পেয়ে নামের সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘স্যার‘। কিন্তু তিনি ব্র্যাকের সব কর্মীর ভাই, আবেদ ভাই।
তিনটি ঘটনাতেই সালামের উত্তরে সালাম দিলেন। কর্মীদের নাম ধরে জানতে চাইলেন কেমন আছে। পরিচ্ছন্নতা নারী কর্মীর নাম ধরে জানতে চাইলেন, তোমার মেয়ে কেমন আছে? ব্র্যাকের স্কুলে যায় কি না? স্বামী ব্র্যাক থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ঠিকমত ব্যবসা করছেন কি না?
হ্যাচারি ও পোল্ট্রি ম্যানেজারের কাছে জানতে চাইলেন, গত বছরের টার্গেট কী ছিল? কতটা অর্জিত হয়েছে? এবছরের টার্গেট কত? লক্ষ্য অর্জন করা যাবে কি না? খরচ কত, বিক্রি কত? এ জাতীয় আরও অনেককিছু জানতে চাইলেন।
নিরাপত্তা কর্মীকে ধমক দেওয়া কর্মকর্তাকে বললেন, ধন্যবাদ না দিয়ে ধমক দিচ্ছ কেন? তিনি তো আটকে দিয়ে সঠিক কাজই করেছেন।
পুরো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হলো। গাড়িতে যেতে যেতে আলোচনা হলো সেসব নিয়ে। ব্র্যাকের কার্যক্রম শুরুর প্রথম ১৯ বছর প্রতি মাসে সাত দিনের জন্যে সিলেটের শাল্লায় যেতেন ফজলে হাসান আবেদ। যেতেন অন্যান্য এলাকাতেও। কর্মীদের সঙ্গে গল্প করতেন। বলতেন কম। প্রশ্ন করে জানতে চাইতেন বেশি। গরিব মানুষের সঙ্গে কথা বলে বহু কিছু শিখেছেন, একথা সব সময় বলতেন। একারণে ব্র্যাকের একটু পুরনো কর্মী যারা তাদের অধিকাংশেরই নাম জানতেন। আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন, উত্তরবঙ্গের ব্র্যাকের অফিসগুলোতে গিয়েও তার প্রমাণ পেয়েছি। বিশেষ করে নারী কর্মীরা খুব সহজে তার সামনে এসে আপন ভাইয়ের মতো আন্তরিকতা নিয়ে কথা বলতেন। নারীদের দায়িত্বশীলতা ও কর্মক্ষমতার প্রতি অগাধ বিশ্বাস-আস্থা ছিল ফজলে হাসান আবেদের। ‘এক কাঁখে সন্তান আরেক কাঁখে পানি ভর্তি কলসি নিয়ে আমাদের নারীরা নদী বা খালের পার বেয়ে তরতর করে উঠে যেতে পারে। সুতরাং তারা পারেন না এমন কোনো কাজ নেই’, বহুবার একথা শুনেছি তার মুখে।
‘কোনো কাজের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে নেওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ্য স্থির থাকলেই একজন কর্মী দক্ষ ও কর্মঠ হয়ে ওঠেন। ব্র্যাকের শুরু থেকেই এই নীতি আমরা মেনে চলেছি’, ধীর-স্থিরভাবে কথাগুলো বললেন।
পোল্ট্রি ফার্ম বা মাছের হ্যাচারি যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ না হয়, তবে চলতে পারবে না। সেকারণে টার্গেট ও লাভ-লোকসানের হিসেবটা জানা জরুরি। যার থেকে সহজে সামগ্রিক একটা ধারণা পাওয়া যায়।
ভোরে রওয়ানা দিয়ে হবিগঞ্জে ব্র্যাকের চা বাগানে গিয়ে যখন পৌঁছলাম, তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। রাতে খাওয়ার পর বাংলোর বারান্দায় বসে গল্প শুনলাম রাত দেড়টা পর্যন্ত। অতি কম কথা বলা ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে যা বেশ বেমানান। প্রশ্ন করলেও যিনি উত্তর দিতে কৃপণতা করেন, তিনি বলে গেলেন প্রায় প্রশ্ন ছাড়া।
চা শ্রমিকদের জীবন তাকে ব্যথিত করে। তাদের সন্তানেরা পুষ্টিহীন, অসুস্থ। লেখাপড়ার সুযোগ নেই। ব্র্যাকের স্কুল করা হয়েছে বাগানে। আরও বহু করতে হবে। শ্রমিক ও তাদের সন্তানদের জন্যে ব্র্যাকের থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আরও বহু কিছু করার আছে।
বললেন তার লন্ডন জীবনের কথা। গল্পের প্রায় পুরোটা জুড়ে বারবার এলো তার প্রিয় বান্ধবী মারিয়েটার কথা।
ভোরে আসার পথে বেশ কিছুটা চিন্তামগ্ন ছিলেন বলে মনে হয়েছিল। প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, ‘ব্র্যাক সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে পুরনো দিনের বহু কিছু মনে পড়ছিল। ব্র্যাক শুরুর পর থেকে কখনো পেছন ফিরে তাকানো হয়নি। এত কাজ করেছি যে সময়ই পাইনি।’
ফজলে হাসান আবেদের রাস্তায় আসতে আসতে দুটি ঘটনা মনে পড়ছিল। তিনি যা বললেন তা মোটামুটি এমন:
১৯৭১ সালের মে মাসের দিকে লন্ডন চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন শেল তেল কোম্পানির হেড অব ফাইন্যান্স। ঢাকা থেকে ইসলামাবাদে গিয়ে আইএসআই’র হাতে ধরা পড়লাম। দুই তিন দিন পর ছাড়া পেলাম। এখন আমরা স্বাধীন দেশের রাস্তা দিয়ে চলি। কেমন ছিল আমাদের একাত্তরের সেই দিনগুলো! দেশের বাইরে যেতে হলে পাকিস্তান সামরিক সরকারের অনুমতি নিতে হবে। তা খুব কঠিন বা অসম্ভব। অনুমতি না নিয়ে লন্ডনে যেতে হলে আগে আফগানিস্তান যেতে হবে। সেই পথ দুর্গম, ঝুঁকিপূর্ণ। ভারতে চলে যাওয়া সহজ ছিল। কিন্তু আমার জন্যে ভারতের চেয়ে ইংল্যান্ডে গেলে বেশি অবদান রাখতে পারব। ফলে চরম ঝুঁকির পথই বেছে নিলাম। ইসলামাবাদ থেকে ট্যাক্সিতে রওয়ানা দিলাম পেশোয়ারের উদ্দেশে। অজানার পথে যাত্রা। চার পাঁচ ঘণ্টা পর পৌঁছলাম পেশোয়ার। সন্ধ্যা নেমে এলো। আজ এখানে যে সময় এলাম অনেকটা তেমন। রাত থাকলাম পেশোয়ারের একটা হোটেলে। সকালবেলা বাসে রওয়ানা দিলাম খাইবারপাস সীমান্তের উদ্দেশে। খাইবারপাস সীমান্ত দিয়ে পাসপোর্ট দেখিয়ে আফগানিস্তানে ঢুকে গেলাম। কিছুটা ভয়-আতঙ্ক কাটল।প্রথমে একটি বাসে জালালাবাদ গেলাম। জালালাবাদ থেকে আরেকটি বাসে কাবুল। ‘হোটেল কাবুলে’ উঠলাম। সঙ্গে বেশি টাকা না থাকলেও দামি হোটেলে উঠলাম নিরাপত্তা বিবেচনায়। টেলিগ্রাম করে লন্ডন থেকে টিকেট আনিয়ে চলে গেলাম লন্ডন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজে লেগে গেলাম। সেই কাজ থেকে কোনোদিন বিরতি নেইনি। কখনো ক্লান্তি আসেনি। সব সময় মনে হয়েছে আরও কাজ করতে হবে।
আজ আরেকটি যাত্রার কথা ভাবছিলাম।
১৯৭৪ সালে খবর পেলাম রৌমারী এলাকায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। রৌমারী যাত্রার সেই অভিজ্ঞতা!
ঢাকা থেকে রংপুর। রংপুর থেকে ট্রেনে কুড়িগ্রাম পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। একটি দোকানের ভেতর রাতে থাকার ব্যবস্থা হলো। তুমুল বৃষ্টির রাত। কিসের ঘুম, কাকভেজা হয়ে গেলাম। রাতটা মনে হলো কয়েক’শ ঘণ্টার। চিলমারী হয়ে যেতে হবে রৌমারী। কিন্তু চিলমারী যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। বহু চেষ্টা করে থানা সার্কেল অফিসারের গাড়িতে পৌঁছলাম চিলমারী। চিলমারী থেকে যেতে হবে নদী পথে। কোনো ব্যবস্থা নেই। চেষ্টা-তদ্বির করে একটি স্পিডবোট জোগাড় করলাম। অষ্টমীর চরে গিয়ে নামলাম, রাত হয়ে গেছে। অষ্টমীর চরে থাকার ব্যবস্থা নেই, রৌমারী যাওয়ারও ব্যবস্থা নেই। কোনো উপায় না পেয়ে হাঁটতে শুরু করলাম রাতের অন্ধকারে। ঠিক পথে যাচ্ছি কি না তাও বুঝতে পারছিলাম না। ১৭ মাইল হেঁটে পৌঁছলাম রৌমারী।
ব্র্যাকের প্রথম কাজ শাল্লায় যাওয়ার সময়ও বাজারের একটি ঘরে রাতে ছিলাম। ঝড়বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম, একটুও ঘুমাতে পারিনি। তখন আমি ৩৬ বছরের যুবক। শাল্লায়ও পৌঁছেছিলাম ১৭ মাইল হেঁটে রাত চারটায়।
ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাককে নিয়ে পুরোটা জীবন হেঁটেছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছেছেন খাবার স্যালাইন নিয়ে। কলার ভেতরে মুরগির ভ্যাকসিন বহনের নিজস্ব পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। গ্রামের হাঁস-মুরগির মড়ক প্রতিরোধে যা তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে। পোল্ট্রি ফিড আমদানী করার নীতিতে নয়, কৃষককে উৎসাহ দিয়ে ভুট্টার আবাদ বৃদ্ধি করেছেন। ব্র্যাক পোল্ট্রি ফিড উৎপাদন করেছে। চীন থেকে বিশেষজ্ঞ এনে হাইব্রিড বীজ দেশে উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন। গ্রামীণ নারীদের অধিকতর কর্মসংস্থানের জন্যে গড়ে তুলেছেন আড়ং। দেশে উৎপাদিত লবণে আয়োডিনের ঘাটতি দূর করার চেষ্টা করেছেন। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সাড়া না দেওয়ায় ব্র্যাক আয়োডিন সমৃদ্ধ লবণ তৈরি করেছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবন-মান উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন।
ফজলে হাসান আবেদের জীবনের মূলমন্ত্র ছিল ‘যে কাজ করতে পারব না, সে কাজে হাত দেব না। যে কাজ করব, সেটা ভালোমতো করব।’
এই নীতিতে বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তান-আফ্রিকায় ব্র্যাক বিস্তৃত হয়েছে। সব জায়গায় সফল, কোথাও ব্যর্থতার নজীর নেই।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে যাওয়ার পরে তার উপলব্ধি ছিল, আরও আগে আসা উচিত ছিল। কত কিছু করার ছিল আফগানিস্তানে। একাত্তরে আফগানিস্তান হয়ে লন্ডনে যাওয়ায় আলাদা একটি টান ছিল। কিন্তু তিনি আঞ্চলিকতায় বিশ্বাস করতেন না। দেশ-কালের সীমানা দিয়ে মানুষকে দেখতেন না। তিনি গরিব মানুষের জন্যে কিছু করতে চাইতেন। বারবার বলতেন, ভারতে কত গরিব মানুষ। তাদের জন্যেও অনেককিছু করার ছিল। যা করা হলো না।
জন্মস্থান সিলেটের বানিয়াচংয়ে গেলে চাকরি প্রত্যাশী মা-বাবারা সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ভিড় জমাতেন। ‘ব্র্যাকে চাকরির ক্ষেত্রে বানিয়াচং বা সিলেটের মানুষ অগ্রাধিকার পাবেন, আমরা এমন নীতি কখনও নেইনি। সিলেটের বানিয়াচংয়ের অনেক মানুষের চাকরি হয়েছে ব্র্যাকে।সেটা আর দশটি জেলার মানুষের চাকরি পাওয়ার যে প্রক্রিয়া, এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়নি।’
গরিব মানুষের জন্যে কিছু করার অনুপ্রেরণা ছিলেন তার মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালীন তার মা মারা যান। দেশে ফেরার টান হারিয়ে ফেলেন। ইংল্যান্ডে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। ভালো চাকরি করছিলেন ইংল্যান্ডে। কিছুদিন চাকরি করেন আমেরিকায়, কিছুদিন কানাডায়। মুক্তিযুদ্ধ ফজলে হাসান আবেদকে আবার দেশে ফিরিয়ে আনল। দেশে ফিরে এলেন ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি। ফেব্রুয়ারি মাসে ‘বাংলাদেশ রিহ্যাবিলেটেশন অ্যাসিসটেন্স কমিটি (ব্র্যাক)’ প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের ইংল্যান্ডের ফ্ল্যাট বিক্রির ৬ হাজার ৮০০ পাউন্ড নিয়ে ব্র্যাকের যাত্রা শুরু সিলেটের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা শাল্লায়।
একদিন আলোচনা হচ্ছিল ব্র্যাকের অর্থ সম্পদ নিয়ে। বাংলাদেশের বহু মানুষ মনে করেন ব্র্যাকের মালিক ফজলে হাসান আবেদ। আড়ংয়ের লাভ মানে আপনার লাভ। যথারীতি সেই ভুবন ভোলানো মৃদু হাসি মুখে বললেন, ‘সব আমার? আমার ধারণা এমন ধারণা অল্প কিছু মানুষের থাকতে পারে। ব্র্যাকের কোনো সম্পদই আমার না, সেটা সবাই জানে।আমি নিজে ব্র্যাকের প্রথম ডোনার।কখনো অর্থ-সম্পদের মালিক আমি হবো না, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার চিন্তাও কখনো করিনি।’
ফজলে হাসান আবেদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিজে কোনো অর্থ-সম্পদের মালিক হবেন না। এই অবস্থান থেকে কখনো সরে যাননি। ব্র্যাকের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। তার কোনোকিছুর মালিক ফজলে হাসান আবেদ নয়। তার সন্তানরাও মালিক না। যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, সেটার মালিক ব্র্যাক।
একজন মানুষ এক জীবনে নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান ব্র্যাককে পরিণত করে গেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থায়। নিজে পেয়েছেন কিংবদন্তির মর্যাদা।
দেশের অন্যতম বৃহৎ জমিদার পরিবারে ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল জন্ম ফজলে হাসান আবেদের। বর্ণাঢ্য তার জীবন। দেশে তো বটেই পৃথিবীব্যাপী তার ও তার গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি। অথচ তার ও তার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে লিখিত তেমন কিছু নেই। এই সূত্রেই ফজলে হাসান আবেদের কাছাকাছি আসার সুযোগ তৈরি হয়।
সংবাদকর্মী হিসেবে বেশ কয়েকবার তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। পরিচয়ের সূত্র ছিলেন বিচিত্রা সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী। ফজলে হাসান আবেদ ও ব্র্যাক সম্পর্কে জানার লিখিত তেমন কিছু নেই। এটা প্রথম জানার সুযোগ হলো ২০০২ সালে। ফজলে হাসান আবেদের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। যা প্রকাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র কিছু শিক্ষার্থী যোগাযোগ করেন। তারা ব্র্যাক সম্পর্কে আরও জানতে চান। তাদের সব প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকায়, ব্র্যাকের তৎকালীন জনসংযোগ পরিচালক তাজুল ইসলামের শরণাপন্ন হই। শিক্ষার্থীদের তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেই। তিনিও শিক্ষার্থীদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না, মানে ব্র্যাক সম্পর্কে বহু তথ্য তারও জানা নেই। লিখিতও কিছু খুঁজে পাওয়া গেল না। অত্যন্ত সজ্জন মানুষ তাজুল ইসলাম বললেন, এসব বিষয় আবেদ ভাই ছাড়া আর কেউ জানেন না। জানতে হলে আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এরই মধ্যে একদিন মাওলা ব্রাদার্সের কর্ণধার আহমেদ মাহমুদুল হক প্রস্তাব দিলেন, ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে কথা বলে ব্র্যাক নিয়ে একটি বই লেখার।
সময় নিয়ে গেলাম ফজলে হাসান আবেদের কাছে। শিক্ষার্থীদের তথ্য না পাওয়া, ব্র্যাক গড়ে ওঠার লিখিত ইতিহাস না থাকা বিষয়ে যা যা গুছিয়ে গিয়েছিলাম, সব বললাম। ধৈর্য ধরে শুনলেন।
তারপর ফজলে হাসান আবেদ যা বললেন তা মোটামুটি এরকম:
‘আমরা মানুষের জন্যে কাজ করেছি, কাজ করছি। দেশের মানুষ ব্র্যাককে জানে কাজের মধ্য দিয়ে। আমাকেও হয়ত কিছু মানুষ চেনেন ব্র্যাকের কাজ দিয়েই। দেশের বাইরে থেকে ব্র্যাককে পুরস্কৃত করে, আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানায়, কাজ দেখে। শিক্ষার্থীরা ব্র্যাক সম্পর্কে জানবে কাজ দেখে। ব্র্যাক কী কাজ করে সেটা জানলেই ব্র্যাককে জানা হবে। আমাদেরই দায়িত্ব লিখিতভাবে তা জানানো, সেভাবে কখনও ভেবে দেখিনি। এভাবে ভাবার দরকার আছে বলেও মনে করি না।’
আপনি জমিদারের সন্তান, ইংল্যান্ডে পড়তে গেলেন, মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখলেন, এত বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। যত সহজে বলছেন, ব্র্যাকের জন্ম-সংগ্রাম নিশ্চয়ই এত সহজ-সরল ছিল না। সেই ইতিহাস লিখিত থাকবে না? এখন সবাই বলেন, আবেদ ভাই জানেন। আপনার অবর্তমানে একেকজন একেক রকম করে বলবেন ইতিহাস।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। ভেবে দেখি।’
ভেবে দেখতে কেটে গেল কয়েক মাস। তারপর একদিন জানালেন, ‘ঠিক আছে। কথা বলব।’
কথা বলতে রাজি হলেন। সমস্যা হলো সময় নিয়ে। ঢাকায় এত কাজের মাঝে একনাগাড়ে কথা বলা যাবে না। কথা হবে ঢাকার বাইরে, যাওয়ার পথে গাড়িতে। তিন বছরে অনেকবার কথা বলে লেখা বই ‘ফজলে হাসান আবেদ ও ব্র্যাক’।
আরও পড়ুন: The President of the Poor People
চলে গেলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ার কারিগর
বনানীতে চিরনিদ্রায় শায়িত স্যার ফজলে হাসান আবেদ
‘বাংলাদেশকে বুঝতে হলে আবেদকে বুঝতে হবে’
মানুষের জন্য কাজ করতে হবে, ব্র্যাক শুরু করার সময় এই ছিলো একমাত্র চিন্তা
Comments