১৯৭১: ভাগীরথীর কথা কেউ মনে রাখেনি!

ছবি: স্টার

হাত দুটো রশি দিয়ে বাঁধা। সেই রশি মোটরসাইকেলের পেছনে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় দুই সন্তানের মা, বিধবা ভাগীরথী সাহাকে— ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না মৃত্যু নিশ্চিত হয়। তারপর সেই ক্ষতবিক্ষত দেহ ফেলে দেওয়া হয় বলেশ্বর নদীতে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করাই ছিল ভাগীরথীর অপরাধ!

১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পিরোজপুর শহরের রাস্তায় বর্বরোচিত এ নির্যাতনের ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই আত্মদানের স্বীকৃতি মেলেনি ভাগীরথীর।

দুই ছেলে নিয়ে অল্প বয়সে বিধবা হন ভাগীরথী। তিন জনের সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হতো। বাধ্য হয়েই পিরোজপুর সদর উপজেলার বাঘমারা গ্রাম থেকে নৌকায় করে ১০ কিলোমিটার দূরে পিরোজপুর শহরে যেতেন বাসা-বাড়িতে কাজের জন্য। চারিদিকে তখন যুদ্ধ চলছে। কিন্তু, পরিবারের খাবারের যোগান দিতে ঘর থেকে বেরোতেই হয় তাকে। একদিন রাজাকার-আলবদর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায় শহরের ক্যাম্পে। ধর্ষণসহ পাশবিক নির্যাতন চলে ভাগীরথীর উপর।

এ ঘটনায় নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করার দৃঢ় সংকল্প নেন ভাগীরথী। আর এ লক্ষ্যেই নিয়মিত ক্যাম্পের সংবাদ নেওয়া শুরু করেন তিনি। সেসব গোপন তথ্য স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে সহায়তা করতে শুরু করেন।

তবে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে সহযোগিতা করার সংবাদ আর গোপন থাকে না। এক সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী টের পেয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বর্বর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে হত্যা করা হয় ভাগীরথীকে।

নদী থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মরদেহ উদ্ধার করে স্বজনরা তার গ্রামের বাড়িতে সৎকার করে। এখনও তার সমাধির শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু পড়ে আছে বাড়ির এক নির্জন কোণায়।

তবে দেশের জন্য সর্বোচ্চ আত্মদানকারী এই নারীর জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি তেমন কোন উদ্যোগ। পিরোজপুর শহরে স্থাপিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে ভাগীরথীর নাম রয়েছে চতুর্থ স্থানে। আর শহরের কৃষ্ণচূড়া মোড়টিতে তার নামে রয়েছে একটি ফলক।

দেশ স্বাধীনের দীর্ঘ সময় পরও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে।

ভাগীরথীর ছোট ছেলে গণেশ সাহা (৬০) দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, তার বয়স যখন ছয় মাস তখন বাবা পিরুনাথ সাহা মারা যান। এরপর তার মা ভাগীরথী সাহা তাদের দুই ভাইকে নিয়ে জীবন সংগ্রাম শুরু করেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে মাকে হারান গণেশ। তার বড় ভাই কার্তিক সাহা মারা গেছেন প্রায় ৭ বছর আগে।

গণেশের অভিযোগ, দেশ স্বাধীনের জন্য তার মা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করলেও, তার মায়ের জন্য কিছুই করেনি রাষ্ট্র। এমনকি তার মায়ের স্মৃতিচিহ্নটুকুও সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দারিদ্রের কারণে নিজ উদ্যোগে তিনি সেটি সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা করতে পারেননি।

গণেশের আরও অভিযোগ, তিনি বছরের পর বছর সংশ্লিষ্টদের কাছে ধর্ণা দিয়েছেন। তবে তাদের জন্য কোনো সহযোগিতার হাত বাড়াননি কেউ। এমনকি, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে তাদের আমন্ত্রণও জানানো হয় না।

পিরোজপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সমীর কুমার দাস বাচ্চু ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে যতগুলো নির্মম ঘটনা ঘটেছে তার একটি পিরোজপুরের ভাগীরথী সাহার ঘটনা।’

অসহায় শহীদ এ পরিবারটির প্রতি সরকারের দৃষ্টি দেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago