শীর্ষ খবর
প্রবাস

মেসিডোনিয়ায় বড়দিনের ভিন্ন সংস্কৃতি

খ্রিষ্টধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিন। মূলত যিশুখ্রিষ্টের জন্ম উপলক্ষে প্রতি বছর খ্রিষ্টধর্মালম্বীরা বড়দিন উৎসবের আয়োজন করেন। খ্রিষ্টানপ্রধান ইউরোপজুড়ে অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে বড়দিন উদযাপন করা হয়।
Mecidonia Christmas
মেসিডোনিয়ায় বড়দিনের আলোকসজ্জা। ছবি: ইরেনা প্রসহিচের কাছ থেকে নেওয়া

খ্রিষ্টধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিন। মূলত যিশুখ্রিষ্টের জন্ম উপলক্ষে প্রতি বছর খ্রিষ্টধর্মালম্বীরা বড়দিন উৎসবের আয়োজন করেন। খ্রিষ্টানপ্রধান ইউরোপজুড়ে অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে বড়দিন উদযাপন করা হয়।

বড়দিন আসার অন্তত এক মাস আগের থেকেই ইউরোপের শহরগুলোর রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে শপিং মল, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে আলোকসজ্জা করা হয়। রাস্তার দুপাশ সাজানো হয় সান্তা ক্লজ আর বলগা হরিণের মূর্তি দিয়ে।

বড়দিনকে সামনে রেখে শহরের বিভিন্নস্থানে কনসার্টের আয়োজন করা হয়। উৎসবের একটি আকর্ষণ হচ্ছে ক্রিস্টমাস মার্কেট। ক্রাকো, ওয়ারশ, নোভি সাদ, স্টকহোম, প্রাহা, হেলসিংকি, কোলন, ড্রেসডেনসহ ইউরোপের অনেক শহরে শুধুমাত্র ক্রিস্টমাস মার্কেট দেখার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আসেন।

উৎসবের দিনটি সাধারণত সবাই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উদযাপন করতে ভালোবাসেন। এ কারণে যান্ত্রিকতার চাদরে মোড়া ইউরোপীয়রা অন্তত বছরের এই একটি দিন তাদের পরিবারের সবার সঙ্গে এক হয়ে উৎসব উপভোগের চেষ্টা করেন।

সচরাচর আমরা ২৫ ডিসেম্বরকে বড়দিন হিসেবে জেনে এসেছি। তবে এখনো খ্রিষ্টানদের একটি বড় অংশ বিশেষ করে অর্থোডক্স খ্রিষ্টানরা ২৫ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ৭ জানুয়ারি বড়দিন উৎসবের আয়োজন করে থাকেন।

স্লোভেনিয়াতে অভিবাসীদের একটি বড় অংশ মেসিডোনিয়ার অধিবাসী। ফেসবুকের বদৌলতে পরিচয় হয় উত্তর মেসিডোনিয়া দেশটির ইরেনা প্রসহিচের সঙ্গে। তার কাছে জেনেছি উত্তর মেসিডোনিয়া, গ্রিক ও বুলগেরিয় মেসিডোনিয়া তথা বৃহত্তর মেসিডোনিয়ায় বড়দিনের আয়োজন সম্পর্কে।

ইরেনা জানিয়েছেন, বৃহত্তর মেসিডোনিয়ায় ক্রিস্টমাস উদযাপনের ধরন ইউরোপের অন্যান্য দেশের থেকে আলাদা। মেসিডোনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ অর্থোডক্স খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী হলেও বাস্তব জীবনে কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়া বেশিরভাগ অঞ্চলে মানুষের মধ্যে ধর্মের তেমন প্রভাব নেই।

ক্রিস্টমাসকে মেসিডোনিয়ায় একটি সামাজিক উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হয় উল্লেখ করে তিনি আরও জানিয়েছেন, মেসিডোনিয়াতেও ক্রিস্টমাস ট্রি, বর্ণিল আলোকসজ্জা কিংবা ক্রিস্টমাস মার্কেটের প্রচলন আছে। তবে তা যতোটা না ক্রিস্টমাসকেন্দ্রিক তার থেকে বেশি আসন্ন নতুন বছরকেন্দ্রিক।

মেসিডোনিয়াতে বড়দিনের উৎসবে ক্রিস্টমাস ট্রির পরিবর্তে ওক গাছের প্রাধান্য থাকে বেশি বলেও জানিয়েছেন ইরেনা। বলেছেন, রূপকথার সান্তা ক্লস মেসিডোনিয়ার সংস্কৃতিতে তেমন জনপ্ৰিয় হয়ে উঠতে পারেনি। ক্রিস্টমাস উপলক্ষে ৭ ও ৮ জানুয়ারি উত্তর মেসিডোনিয়ায় সরকারি ছুটি থাকে।

Mecidonia Christmas
মেসিডোনিয়ায় বড়দিনে বিশেষ খাবারের আয়োজন। ছবি: ইরেনা প্রসহিচের কাছ থেকে নেওয়া

জানুয়ারির পাঁচ তারিখে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে মেসিডোনিয়ায় শুরু হয় বড়দিনের আনুষ্ঠানিকতা। পরিবারের সদস্যরা প্রথা মেনে সে সময় বাড়ির উঠানে ইয়ুল নামক এক বিশেষ প্রজাতির ওক গাছের গুঁড়িতে আগুন জ্বালিয়ে অগ্নিকুণ্ড সৃষ্টি করেন।

ছয় জানুয়ারি সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ছোটো বাচ্চারা দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়ায় এলাকার বিভিন্নজনের বাসায়। সে সময় তারা বিভিন্ন ধরনের গান গায়। সেদিন নির্দ্বিধায় যে কারো বাড়ির আঙিনায় যাওয়া যায়। বাড়ির কড়া নাড়লে কেউ আপত্তি জানান না।

এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠরা সেদিন বাচ্চাদের জন্য চকলেট ও ক্যান্ডি, ফল, বাদাম কিংবা খেলনাসহ বিভিন্ন উপহারের ব্যবস্থা করে থাকেন। যারা তুলনামূলকভাবে ধর্মভীরু তাদের অনেকে সেদিন কিংবা পরদিন চার্চ ও মৃত আত্মীয়-স্বজনের কবর দর্শনে যান।

ইরেনার কাছ থেকে জানা গেছে, ছয় জানুয়ারির মূল আকৰ্ষণ হচ্ছে রাতের খাবার। সেদিন পরিবারের সব সদস্যরা এক সঙ্গে রাতের খাবার খান।

মেসিডোনিয়ার ভাষায় ছয় জানুয়ারির রাতের এ খাবারকে বলা হয় ‘পসনা’। সেদিনের রাতের খাবারের প্রায় সব আইটেম বিভিন্ন সবজি দিয়ে তৈরি করা হয়। সাধারণত ছয় জানুয়ারির রাতে মেসিডোনিয়ানরা দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, মাংস ও আমিষ জাতীয় সব খাবার পরিহার করেন।

ক্রিস্টমাস উপলক্ষে মেসিডোনিয়ায় এক বিশেষ ধরনের পাউরুটি তৈরি করা হয়। পরিবারের সব সদস্যের জন্য মাথাপিছু একটি করে পাউরুটি বরাদ্দ থাকে। অতিরিক্ত আরও দুইটি পাউরুটি তৈরি করা হয়। একটি সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে ও অন্যটি নিজেদের ঘরের মঙ্গল কামনায় উৎসর্গ করা হয়।

পাউরুটি তৈরি করার সময় যেকোনো একটিতে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি কয়েন দেওয়া হয়।

ইরেনা আরও জানিয়েছেন, সাত জানুয়ারি তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকে না। পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়ে সেদিন দুপুরের খাবার খান। দুপুরের খাবারে সাধারণত রোস্টেড মাংস, সসেজ, পনিরের পাই, বিভিন্ন ধরনের রুটি, সালাদ ও কেক থাকে।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রিস্টমাসের অভিবাদন জানাতে সবাই ‘মেরি ক্রিস্টমাস’ বললেও মেসিডোনিয়াতে বলা হয় ‘হ্রিসতোস সে রোদি’। এর বাংলা অর্থ ‘যিশুখ্রিষ্ট্রের জন্ম হয়েছে’। এর প্রতি-উত্তরে বলা হয়, ‘নাভিস্তিনা সে রোদি’ অর্থাৎ ‘সত্যিই তিনি (যিশুখ্রিষ্ট) জন্মগ্রহণ করেছেন’।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় মেসিডোনিয়ার বড়দিন সংস্কৃতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ক্যাথলিক দেশগুলোর মতো অর্থোডক্স মেসিডোনিয়াতেও ক্রিস্টমাস ট্রি কিংবা রূপকথার সান্তা ক্লসের সংযোগ ঘটেছে। নতুন প্রজন্মের অনেকে এখন ‘হ্রিসতোস সে রোদি’ কিংবা ‘নাভিস্তিনা সে রোদি’র পরিবর্তে ‘শ্রেকেন বোজিক’ বলে থাকেন, যার ইংরেজি ‘মেরি ক্রিস্টমাস’।

রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া

Comments

The Daily Star  | English
Is human civilisation at an inflection point?

Is human civilisation at an inflection point?

Our brains are being reprogrammed to look for the easiest solutions to our most vexing social and political questions.

9h ago