কীটনাশকে ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ, বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেই

দেশে বহুল ব্যবহৃত কয়েক ডজন কীটনাশকে ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ও সীসার মতো ক্ষতিকারক ধাতব পদার্থের সন্ধান পাওয়া গেছে প্রায় বছরখানেক আগেই। কিন্তু এসব ক্ষতিকারক ধাতব পদার্থ মিশ্রিত রাসায়নিকের আমদানি রোধ করতে এখনো প্রয়োজনীয় পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে পারেনি সরকার।
Pesticides_26Dec20.jpg
কীটনাশকে ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ও সীসার মতো ক্ষতিকারক ধাতব পদার্থের সন্ধান পাওয়া গেলেও আমদানি রোধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। ছবি: স্টার

দেশে বহুল ব্যবহৃত কয়েক ডজন কীটনাশকে ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ও সীসার মতো ক্ষতিকারক ধাতব পদার্থের সন্ধান পাওয়া গেছে প্রায় বছরখানেক আগেই। কিন্তু এসব ক্ষতিকারক ধাতব পদার্থ মিশ্রিত রাসায়নিকের আমদানি রোধ করতে এখনো প্রয়োজনীয় পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে পারেনি সরকার।

গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আমদানি করা কীটনাশক বন্দর থেকে ছাড় করার আগে দুটি মনোনীত সরকারি পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করানো বাধ্যতামূলক করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। তবে আমদানিকারকদের অনুরোধে এই তারিখ পিছিয়েছে কয়েকবার।

বিএফএসএ-এর চেয়ারম্যান মো. আবদুল কাইয়ূম সরকার সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কৃষিক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিবেচনা করে আমাদের নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করার জন্য তারা (আমদানিকারকরা) অনুরোধ করেছিলেন।’

তিনি জানান, কীটনাশকগুলোতে ভারী ধাতুর ক্ষতিকারক প্রভাব পরিমাপ করার জন্য আরও গবেষণার আহ্বান জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। এ কাজের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রয়েছে।

গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি ক্ষতিকারক ধাতব পদার্থ মিশ্রিত কীটনাশক বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শাস্তির আওতায় আনার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে অনুরোধও জানিয়েছিল বিএফএসএ। অধিদপ্তরকে লেখা একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই কীটনাশকগুলোতে উচ্চ মাত্রায় ভারী ধাতু উপস্থিতি রয়েছে। এই ভারী ধাতুগুলো মারাত্মকভাবে খাদ্য শৃঙ্খলকে দূষিত করছে।’

এতে আরও বলা হয়, ‘দেশে ব্যবহৃত বেশিরভাগ কীটনাশক আমদানি করা হয়। কীটনাশক আইনে ভারী ধাতু মুক্ত কীটনাশক আমদানি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।’

আবদুল কাইয়ূম বলেন, ‘পরিবেশের ক্ষতি করে এমন কিছু আমরা দেশে প্রবেশ করতে দিতে চাই না, কৃষি বিভাগও চায় না। তবে আমরা এটাও চাই না যে দেশের কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হোক। এই দুইয়ের মধ্যে অবশ্যই ভারসাম্য রাখতে হবে।’

এই ভারসাম্য রাখতেই বারবার পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে কীটনাশক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার তারিখ। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর) কাছ থেকে আমরা এখনো কোনো আপডেট পাইনি।’

কীটনাশকের নামমাত্র পরীক্ষা

দেশের শীর্ষস্থানীয় কীটনাশক নিয়ন্ত্রক সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ফেব্রুয়ারিতে এ বিষয়ে সর্বশেষ বৈঠক করেছে। বৈঠকে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। যার কাজ হবে, কীটনাশকগুলোকে অনুমোদনযোগ্য ভারী ধাতুর সীমা সম্পর্কে একটি গাইডলাইন প্রস্তুত করা।

তবে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, ওই বৈঠকের পর এখন পর্যন্ত আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। গাইডলাইনটি প্রস্তুত করার জন্য নয় মাস সময় যথেষ্ট ছিল কি না জানতে চাইলে বিএফএসএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘এই প্রশ্নটা আপনি কৃষি মন্ত্রণালয় বা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে করুন। এটা তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি প্রশ্ন।’

দেশে ব্যবহৃত সারে ভারী ধাতুর সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া থাকলেও কীটনাশকের ক্ষেত্রে নেই। বিশ্বব্যাপী কোথাওই এই সীমা নির্ধারণ করা নেই। তবে বাংলাদেশ কীটনাশক আইন ২০১৮ এর ১৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি কোনো কীটনাশকে ভেজাল বা ভুল বা বিভ্রান্তিকর ট্যাগ করা ধরা পড়ে, তবে সরকার সেই কীটনাশক আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধ করতে পারে।

অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩৮ হাজার টন কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এর প্রায় ৯০ শতাংশই আমদানি করা হয় চীন থেকে।

অধিদপ্তরে নিবন্ধিত ৩০০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং সিঙ্গাপুর থেকে ফসল রক্ষাকারী রাসায়নিক আমদানি করে।

কীটনাশকগুলো বিপণনের আগে এতে কী কী উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে তা অধিদপ্তরকে জানিয়ে অনুমোদন নিতে হয়। অধিদপ্তর শুধুমাত্র পোকামাকড় ও আগাছা নিধনে কীটনাশকের দক্ষতা এবং মাছের ওপর এর বিষাক্ততা পরীক্ষার মতো ন্যূনতম পরীক্ষা চালায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যদি কোনো নির্দিষ্ট সীমা দেওয়া থাকতো তাহলে আমরা বলতে পারতাম এটা ভেজাল।’

এই সীমা নির্ধারণ কবে নাগাদ হতে পারে এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গঠিত উপদেষ্টা কমিটি কীটনাশকে অনুমোদনযোগ্য ভারী ধাতুর সীমা সম্পর্কিত গাইডলাইন কবে নাগাদ দিতে পারেন— এমন প্রশ্নের জবাবে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (বালাইনাশক মান নিয়ন্ত্রণ) মো. আমিনুর ইসলাম বলেন, ‘উপদেষ্টা কমিটির এখনো একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়নি। তারা গাইডলাইনটি নিয়ে আলোচনা করতে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে বসবেন।’

বিশেষজ্ঞদের মতামত

বিশেষজ্ঞদের মতে, কীটনাশকে কোনো ভারী ধাতুর উপস্থিতি থাকা উচিত না। কীটনাশকের মাধ্যমে খাদ্য-শৃঙ্খল দূষিত হচ্ছে। যা মারাত্মক হুমকি ও দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী ফরহাদ কাদির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ভারী ধাতু কীটনাশকের উপাদান না। কীটনাশকই তো ক্ষতিকর। তার মধ্যে আবার ভারী ধাতু যত অল্প পরিমাণেই থাকুক না কেন, সেটা তো এই ক্ষতির পরিমাণ বাড়াবে।’

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘কীটনাশকের মান নির্ভর করে এর সক্রিয় কাঁচামালের দাম বা আমদানি মূল্যের উপর। পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পেয়েছি, অনেক কীটনাশকে প্যাকেটে বর্ণিত পরিমাণের চেয়ে ৫০ শতাংশ কম সক্রিয় উপাদান রয়েছে। এর পরিবর্তে কীটনাশকগুলো থাকে ভারী ধাতুর অপদ্রব্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমদানি থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই নজরদারির বড় অভাব রয়েছে। তার ফল দেখা যাচ্ছে খাদ্য-শৃঙ্খলে।’

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

53m ago