মুক্তিযোদ্ধার দোকানঘর ভেঙে দেওয়ার পর মামলা দিয়ে হয়রানি
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ঘেঁষা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ নাগের দুটি দোকান ঘর খননযন্ত্র (এসকেভেটর) দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর উল্টো ওই মুক্তিযোদ্ধা ও তার মেয়ের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
একই গ্রামের বাসিন্দা পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ও শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান স্বাধীনতাবিরোধী প্রয়াত জিয়াউল আমিন ওরফে নান্না মিয়ার ছেলে ইকরামুল আমিন বাবু মিয়া জায়গাটি নিজের দাবি করে গত ৮ ডিসেম্বর ভোরে ঘর দুটি ভেঙে দেন বলে অভিযোগ করেছেন ওই মুক্তিযোদ্ধা।
এ ঘটনার দিন মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ নাগ বাদী হয়ে ইকরামুল আমিনসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে সরাইল থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। সরাইল থানা দণ্ডবিধির ধারায় মামলাটি লিপিবদ্ধ না করায় তিনি গত ১৩ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া দ্রুত বিচার আদালতে মামলা দায়ের করেন। এরপর গত ২০ ডিসেম্বর আসামিপক্ষের লোকেরা ওই মুক্তিযোদ্ধা ও তার মেয়ের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে পাল্টা মামলা দায়ের করেছেন।
বিজয়ের মাসে রাজাকারের সন্তান কর্তৃক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার দোকানঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতাকর্মীরা। তারা গত ১২ ডিসেম্বর এ ঘটনার প্রতিবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন।
বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার, সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা উত্তম কুমার চক্রবর্তী, দপ্তর সম্পাদক সুবীর দত্ত, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রদ্যুৎ নাগ, জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কাজী মাসুদ আহমেদ, জেলা জাসদ সভাপতি আকতার হোসেন সাঈদ, জেলা তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব মো. নাসির মিয়া, জেলা হিন্দু মহাজোটের সভাপতি জয় শংকর চক্রবর্তী ও সাধারণ সম্পাদক প্রবীর চৌধুরী রিপন এতে অংশ নেন।
উষাতন তালুকদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘রাজাকারের সন্তান বিজয়ের মাসে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে হামলা করার সাহস পায় কী করে? দেশটা কি তাহলে মগের মুল্লুক হয়ে গেছে? আইনের শাসন বলতে কি কিছু নেই এখানে?’
মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ নাগ অভিযোগ করে বলেন, তার প্রতিপক্ষ ইকরামুল আমিনের দায়েরকৃত মামলায় উল্লেখ করা স্থানটিতে কোনো ঘর কিংবা গেইট না থাকা সত্ত্বেও তিনি এবং তার কন্যার বিরুদ্ধে ঘর ও গেইট ভাঙার অভিযোগ আনা হয়েছে।
জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি দিলীপ নাগ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার বাবা রবীন্দ্র মোহন নাগ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। অপরদিকে ইকরামুল আমিনের বাবা ছিলেন একজন চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী ও পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য। পাকিস্তান মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান ও ভাষা আন্দোলন সময়কালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনেরও ঘনিষ্ঠ স্বজন তারা। ভাষা আন্দোলনের সময়ে নুরুল আমিনের নির্দেশেই আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল।’
দিলীপ নাগ জানান, পার্শ্ববর্তী জায়গার মালিক ইকরামুল আমিন তার জায়গাটি দখল করতে নানাভাবে হুমকি দিয়ে আসছিলেন। এতে তিনি ২০১৯ সালে আদালতে মামলা করেন। এরপর আদালত থেকে সমন জারির পরও কোনো সাড়া না দিয়ে ইকরামুল জায়গাটি দখলের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এই নিয়ে গত জুলাইয়ে তিনি সরাইল থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। প্রায় দুই মাস আগে এই জায়গায় তিনি টিনশেডের দুটি দোকানঘর নির্মাণ করেন। গত মঙ্গলবার ভোরে ইকরামুল ২৫/৩০ জনকে সঙ্গে নিয়ে খননযন্ত্র দিয়ে ঘর দুটি গুঁড়িয়ে দেন।
দিলীপ নাগের দাবি, ইকরামুল আমিন মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে তার ব্যক্তিগত জমিসহ সরকারি কিছু জমি নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন। অথচ ১৯৬৮ সালের ৩৭৫৮ নম্বর দলিলে শাহবাজপুর মৌজার তিনটি হাল দাগের মধ্যে ৪৩৬৬ তে ১০ শতক এবং ৪৩৬৮ তে ১০ শতক জায়গা সরকারের এক নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। এ ছাড়া, ৪৩৬৭ দাগটি ওই দলিলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। এর সাবেক দাগ ২৬৯৪ এর এস খতিয়ানে দিলীপ নাগের পিতা রবীন্দ্র মোহন নাগের নাম রয়েছে। কিন্তু, ইকরামুল এই তিন দাগের জমিকে নিজের নামে দাবি করছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ইকরামুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘দোকান ভাঙার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তৃতীয় কোনো পক্ষ ফায়দা লুটতে এমন কাজ করে থাকতে পারে।’
এ বিষয়ে সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নাজমুল আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সবার অগোচরে রাতের অন্ধকারে ঘর দুটি ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ঘটনায় দিলীপ কুমার নাগের দায়ের করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশি তদন্ত চলছে।’
Comments