উজাড় হয়ে যাচ্ছে সাঙ্গু সংরক্ষিত বন

বান্দরবানের থানচি এলাকার একটি দুর্গম সংরক্ষিত বন এবং অভয়ারণ্যে গত দুই মাসে শতাব্দী প্রাচীন বহু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে গত দুমাসে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, বনের প্রায় একশ একর জমি সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেছে গত কয়েক বছরে।

একাধিক উত্স থেকে ভিডিও এবং ছবি সংগ্রহ করেছে দ্য ডেইলি স্টার। যা প্রমাণ দেয় যে শতাব্দী প্রাচীন গাছগুলো সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে অবৈধভাবে কেটে সাঙ্গু নদী দিয়ে পরিবহন করা হচ্ছে।

 

প্রত্যক্ষদর্শী ও থানচির স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, বান্দরবান শহর ও চট্টগ্রামের কাঠ ব্যবসায়ীদের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গত কয়েক বছর ধরে শীতের মৌসুমে এই পাহাড়ি বন থেকে গাছ কাটাচ্ছেন।

তবে এর বিরুদ্ধে কখনই ব্যবস্থা নেয়নি বন। সব সময়ই তারা বলে আসছেন, ‘জনবল ঘাটতি’র কারণে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে তারা পাহারা দিতে পারছে না।

বনের গাছ লুটপাটে বন কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে।

সাঙ্গু বনের মোট আয়তন ৮২ হাজার ৮০ একর। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর এবং এ বছরের ২৯ নভেম্বর নেওয়া স্যাটেলাইট চিত্র থেকে স্পষ্টতই দ্য ডেইলি স্টার দেখতে পায় কয়েক বছর ধরে উজাড় করা হচ্ছে বন।

বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেন্সিং অর্গানাইজেশনের (স্পারসো) নেওয়া এবং বিশ্লেষণ করা স্যাটালাইট চিত্রগুলো থেকে দেখা যায়, বৃহৎ বনাঞ্চলের অন্তত ২৪টি স্পট থেকে গাছ কাটা হচ্ছে।

স্পারসোর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাহমুদুর রহমান সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ৮৬৭ হেক্টর (দুই হাজার একরও বেশি) এলাকার একটি চিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। যার মধ্যে অন্তত ৪০ হেক্টর (প্রায় ১০০ একর) জায়গার সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।

ড. মাহমুদুর জানান, ২০১৬, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে তোলা চিত্রগুলো দেখলে এটা স্পষ্ট হয় যে প্রতি বছরই গাছ কেটে বন খালি করা হচ্ছে।

স্থানীয় গ্রামের অন্তত পাঁচ জনের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। তাদের কেউই নাম প্রকাশে আগ্রহী নন।

তারা বলেন, সংরক্ষিত বনের অন্দরমানিক, ডুংডুং পাড়া, মিলিঙ্গা পাড়া, ম্রংগং পাড়া, নরিষা জিরি, বড়মদোক জিরি এবং সিঙ্গাপা মৌজা জিরি এলাকা থেকে নির্বিচারে গাছ কাটছে।

সম্প্রতি অন্দরমানিক ও নরিশা জিরি এলাকায় গিয়েছিলেন এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তিনি যাদের গাছ কাটতে দেখেছেন তারা মূলত কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে এসেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘তারা নরিশা জিরিতে তাঁবু গেড়েছে এবং সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে পেট্রোল চালিত বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে নির্বিচারে শতবর্ষ পুরানো গাছ কেটে ফেলছে। এভাবে কাটতে থাকলে একদিন বনটি পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে।’

ধ্বংস হচ্ছে সাঙ্গু

গত মাসে থানচির স্থানীয় নু মং প্রু বলেছিলেন, ‘গত কয়েকমাস ধরে সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছিল। দ্য ডেইলি স্টারে প্রতিবেদন প্রকাশের পর, কয়েক সপ্তাহ ধরে গাছ কাটা বন্ধ রেখেছে তারা।’

সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চলে অবৈধভাবে প্রবেশ ও কাঠ পাচারের বিষয়ে স্থানীয়দের বিবৃতি নিয়ে গত ১০ নভেম্বর প্রতিবেদন প্রকাশ করে দ্য ডেইলি স্টার।

থানচি উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান চা সা থোয়াই মারমা বলেন, ‘গত কয়েকমাসে চোরাকারবারিরা সাঙ্গু সংরক্ষিত বন থেকে প্রায় ৩০ হাজার ফুট গাছ কেটে ফেলেছে।’

অবৈধভাবে এসব গাছ কাটতে দেখেছেন এমন একজনের কাছ থেকে তিনি এই তথ্য পেয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, ‘গাছগুলো কেটে সাঙ্গু নদী দিয়ে বান্দরবান শহরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’

সংগৃহীত ছবি এবং ভিডিও থেকে দেখা যায়, সাঙ্গু নদীর তীরে কাটা গাছগুলো জড়ো করে রাখা হয়েছে পরিবহনের জন্য। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গভীর রাতেও কাটা হচ্ছে গাছ।

বান্দরবান শহরে আসার পর সেগুলো ঢাকা এবং চট্টগ্রামে পাঠানো হয়।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বন বিভাগের কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কাঠ পাচারে সহায়তা করেন বলে দাবি করেন স্থানীয়রা।

বান্দরবান জেলা টিম্বার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল বাশার বলেন, ‘প্রায় সাত-আট জন অসাধু ব্যবসায়ী এই বন থেকে গাছ কাটছেন। তাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রামের।’

থানচির একজন স্থানীয় অধিবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি সাঙ্গু সংরক্ষিত বন থেকে কাঠ সরবরাহ করার জন্য জামাল নামে এক কাঠ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নগদ প্রায় ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়েছিলেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের বাসিন্দা মো. জামাল উদ্দিন এই বনের অন্যতম কাঠ পাচারকারী।

যোগাযোগ করা হলে মো. জামাল এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘সাঙ্গু বনে গাছ কাটার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমি বান্দরবান থেকে যারা চট্টগ্রাম ও ঢাকায় কাঠ পাঠান তাদের কাছ থেকে আমি এগুলো কিনেছি।’

বান্দরবানের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিয়া অস্বীকার করেন যে এই বন থেকে গাছ কাটা হয়।

তিনি বলেন, ‘সংরক্ষিত বন রক্ষায় আমাদের সহযোগিতা করতে বলিপাড়া বিজিবি এবং আলিকদম বিজিবিকে আমরা চিঠি পাঠিয়েছি। সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারে প্রতিবেদন প্রকাশের পর আমরা এসিএফ (সহকারী বন সংরক্ষক) এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি পরিদর্শন দলও গঠন করেছি।’

প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসেন চৌধুরী বলেন, সাঙ্গু সংরক্ষিত বনে গাছ কাটার কথা শুনেছি এবং ‘বিষয়টি তদন্তের জন্য আমরা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে আইনি নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা)।

১৮৮০ সালে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষিত হয় সাঙ্গু। এখানে রয়েছে ৩৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৯ প্রজাতির উভচর এবং ১১ প্রজাতির বিরল পাখি।

অরণ্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক উদ্ভিদবিদ ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জানান, এই বনে অনেক দুর্লভ প্রজাতির পুরানো গাছ রয়েছে।

সাঙ্গু বনের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ গাছের প্রজাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে গামার, গর্জন, চাপালিশ, টুন, গোদা, গুটগুটিয়া, চম্পা, সিভিট এবং শিমুল।

বর্তমানে দুবাই চিড়িয়াখানায় কর্তব্যরত বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. রেজা খান জানান, তিনি গত বছর সাঙ্গু সংরক্ষিত বনে গিয়ে গাছ কাটতে দেখেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘আসলে, বান্দরবানে দায়িত্বরত সব সরকারি কর্মকর্তা গাছ কাটা সম্পর্কে জানেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা প্রশাসন ও বন কর্মকর্তাদের অজান্তে কারো পক্ষে গাছ কাটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার যদি পৃথক বন্যপ্রাণী বিভাগ গঠন না করে তাহলে প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে না। কারণ বন অধিদপ্তর বন্যপ্রাণী এবং প্রাকৃতিক বনের বিষয়ে চিন্তা করে না।’

ঝুঁকিতে বান্দরবানের অন্যান্য সংরক্ষিত বন

এই জেলায় তিনটি প্রধান সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। সেগুলো হলো- আলীকদমের মাতামুহুরি, লামার বামু বিলছড়ি এবং থানচির সাঙ্গু।

মাতামুহুরি ও বামুর আয়তন এক লাখ চার হাজার ৮৮২ দশমিক ৪২ একর।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই বান্দরবানের দুই শীর্ষ স্থানীয় বন কর্মকর্তা জানান, এই বনগুলোর অনেক জায়গা খালি এবং অনুর্বর হয়ে গেছে নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে।

লামা বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ মূল্যবান মাতৃগাছ কেটে ফেলার কারণে মাতামুহুরি ও বামু সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।

লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস এম কায়সার বলেন, ‘মাত্র ১৪ জন কর্মী দিয়ে মাতামুহুরি ও বামু বনের এক লাখ চার হাজার ৮৮১ একর জায়গা রক্ষা করা সত্যিই কঠিন।’

Comments

The Daily Star  | English
rally demanding ban on awami league in Dhaka

Blockade at Shahbagh demanding AL ban

The demonstration follows a sit-in that began around 10:00pm last night in front of the Chief Adviser's residence

4h ago