‘মানুষ আমগো কানটানা বইল্যা ডাকে’

রেলস্টেশনের প্লাটফর্ম, বাস টার্মিনাল, ফুটপাত ও হাট-বাজারে দেখতে পাওয়া যায় এদের। এরা সবার কাছে কানটানা বলে পরিচিত। নিজেকে কখনো কানের ডাক্তার আবার কখনো কখনো কানের কবিরাজ বলেও পরিচয় দিয়ে থাকেন।
শরীর বেল্টে আটকানো একটি বাক্স আর মাথায় সার্চ লাইটের মতো একটি যন্ত্র থাকে এদের কাছে। বাক্সটিতে কয়েকটি বোতল ও ছোট ছোট কিছু যন্ত্র থাকে। বোতলগুলোর অধিকাংশই খালি থাকে। শুধু দুটি বোতলে রাখা হয় রাসায়নিক দ্রব্য হাইড্রোজেন-পার-অক্সাইড।
মানুষের কানে জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করেন কানটানারা। ফুটপাতের মানুষও এদের থেকে কান পরিষ্কার করে নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে, শিক্ষিত মানুষরা অনীহা প্রকাশ করেন। আর, প্রতি কান পরিষ্কার করতে ১৫ থেকে ২০ টাকা নিয়ে থাকে এরা।
‘মানুষ আমগো কানটানা বইল্যা ডাকে। আমরাও সাড়া দিয়ে থাকি,’ জানালেন কানটানা বলে পরিচিত কর্ণ কবিরাজ হাবিবুর রহমান (৪৪)।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার মেঘারাম গ্রামের হাবিবুর গত ছয় বছর ধরে এ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এর আগে, তিনি ট্রেনেট্রেনে হকারি করে রকমারি জিনিস বিক্রি করতেন। এক ওস্তাদের কাছে তিন মাসের প্রশিক্ষণ কানটানা হিসেবে কাজ শুরু করেন। দিন শেষে সাতশ থেকে এক হাজার টাকা আয় করে ভালোই আছেন জানান তিনি।
হাবিব আরও জানান, তিনি গ্রামে কর্ণ কবিরাজ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। অনেক মানুষ কানের রোগ নিয়ে তার কাছে আসেন। তিনি তাদের চিকিৎসা দিয়ে সফল হচ্ছেন। কানের ভেতর হাইড্রোজেন-পার-অক্সাইড দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করে কানকে সচল রাখেন তিনি।
হাইড্রোজেন-পার-অক্সাইড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক নিয়ে জানতে চাইলে তিনি অকপটে জানান, এই দ্রব্যটি পরিমাণ মতো ব্যবহার করলে কোনো ক্ষতি হয় না। এ ছাড়া, এ পর্যন্ত কেউ কোনো অভিযোগও করেনি।
লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশন প্লাটফর্মে কানটানার কাজে নিয়োজিত সফিয়ার রহমান (৫২) জানান, তারা নিখুঁতভাবে কান পরিষ্কার করে দেন। আগে অধিক পরিমাণে পারাক্সাইড ব্যবহার করে কান পরিষ্কার করতেন। কিন্তু, এখন পরিমাণ মতো ব্যবহার করে থাকেন। লালমনিরহাট স্টেশন থেকে বোনারপাড়া স্টেশন পর্যন্ত ৪০ জনের বেশি কানটানা কাজ করছেন। তিনি এ পর্যন্ত ১২ জন শিষ্য তৈরি করেছেন এবং তারা ভালোভাবে সংসার চালাচ্ছেন।
‘আমাদের কাছে সাধারণত নিম্ন আয়ের ও ছিন্নমূল মানুষ কান পরিষ্কার করে নেন। খুব কমসংখ্যক শিক্ষিত মানুষ পাই,’ বলেন তিনি।
লালমনিরহাট স্টেশন প্লাটফর্মের পানের দোকানদার জহুরুল ইসলাম (৩৩) জানান, তিনি মাঝে মধ্যে কানটানার কাছ থেকে কান পরিষ্কার করে নেন। তারা যখন কান পরিষ্কার করে তখন ভালোই লাগে। কানের মধ্যে কিছু একটা ঢেলে দিয়ে তারপর কান পরিষ্কার করে দেন তারা।
হাইড্রোজেন-পার-অক্সাইড রাসায়নিক দ্রব্যের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘এমন কোনো কিছুর নাম আমি কখনো শুনিনি।’
লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশন প্লাটফর্মের রেলওয়ে কর্মচারী সুজন চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমি কখনোই ভুল করেও কানটানার কাছে কান পরিষ্কার করি না। এদের কাছে কান পরিষ্কার করালে কানের ক্ষতি হতে পারে। এসব কানটানা কানের জন্য ভয়ঙ্কর।’
নাক, কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অরূপ চক্রবর্তী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ফুটপাতে ঘুরে বেড়ানো কানটানা বলে পরিচতি এসব মানুষের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। কান একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এবং এর ভেতর নরম ও মসৃণ পর্দা থাকে। কোনো কারণে এ পর্দা আঘাতপ্রাপ্ত হলে কান শ্রবণশক্তি হারাতে পারে। কানের মতো নরম মসৃণ স্থানে হাইড্রোজেন-পার-অক্সাইড রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করলে তা যে কোনো সময় চরম ক্ষতি করতে পারে।’
Comments