করোনার নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হয় না বাংলাদেশের পিসিআর পরীক্ষায়

ড. বিজন বলছিলেন, ভাইরাসের চরিত্রই এমন সে বারবার নিজেকে পরিবর্তন করে। উহানে শুরুর সময়ের যে করোনাভাইরাস আর এখনকার সারা পৃথিবীর করোনাভাইরাস এক নয়। বারবার পরিবর্তন হয়েছে।
ছবি: রয়টার্স

• আমাদের এখানে যেভাবে পরীক্ষা হচ্ছে, সেভাবে নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম

• বাংলাদেশেকে জরুরি ভিত্তিতে ‘থ্রি জিন’ পরীক্ষার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে

• করোনার নতুন স্ট্রেইন ৭০ শতাংশ বেশি গতিতে ছড়ায়

• অতিসংক্রমণশীল এই নতুন স্ট্রেইন বাংলাদেশে চলে এসেছে তা হয়ত বলা যাচ্ছে না

• কোনো ভ্যাকসিনই এখন পর্যন্ত পরীক্ষায় প্রমাণিত নয় যে, করোনার নতুন স্ট্রেইনের ক্ষেত্রে কার্যকর কি কার্যকর না

• ১৮ বছর বয়স পর্যন্তদের জন্যে কোনো ভ্যাকসিন নেই। যদি নতুন স্ট্রেইনে তাদের ঝুঁকি প্রমাণিত হয়, তবে ভ্যাকসিন নতুন করে ট্রায়াল করতে হবে

• বাংলাদেশে ভ্যাকসিন কবে-কিভাবে, কত মানুষ পাবে তা নিশ্চিত নয়। ফলে ভ্যাকসিনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার মাস্কে

ড. বিজন কুমার শীল ও ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম। ছবি: সংগৃহীত

‘ব্রিটেনে শনাক্ত করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন আর বাংলাদেশে শনাক্ত নতুন স্ট্রেইনকে কোনোভাবেই এক বলার সুযোগ নেই। তাছাড়া বাংলাদেশে চলমান আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় করোনাভাইরাসের নতুন স্টেইন শনাক্তের সুযোগ বা সক্ষমতাও নেই। নতুন স্ট্রেইন বাংলাদেশে আছে কি না, তারচেয়ে বড় বিষয় চলে আসার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। কোনোভাবে যদি ব্রিটেনের নতুন স্ট্রেইন বা ভ্যারিয়েন্টটি বাংলাদেশে চলে আসে তবে তা সংক্রমণের বিস্তার ত্বরাণ্বিত করতে পারে, যেমনটি করছে যুক্তরাজ্যে’, দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন ড. বিজন কুমার শীল ও ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম। অনুজীব বিজ্ঞানী ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ড. বিজন সিঙ্গাপুরে এবং দ্য ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের সিনিয়র গবেষক ড. আকরাম লন্ডনে অবস্থান করছেন। করোনাভাইরাসের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

বাংলাদেশে আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন শনাক্তের সুযোগ আছে কি না, সরকারের পরামর্শক কমিটির তিন জন বিশেষজ্ঞ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন বিষয়টি তাদের জানা নেই।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বাংলাদেশে আরটি-পিসিআরে টু-জিন (দুইটি জিন) পরীক্ষা করা হচ্ছে। বর্তমানে আমরা যে আরটি-পিসিআর ব্যবহার করছি, সেটাতে হয়তো সবগুলো মিউটেশন বা পরিবর্তন শনাক্ত করতে পারছি না, স্কিপ করে যাচ্ছি। ফলে আমাদের এখানে যেভাবে পরীক্ষা হচ্ছে, সেভাবে নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। সেটা নিয়েই এখন আমাদের আলোচনা যে, আমাদের এই আরটি-পিসিআর হয়তো পরিবর্তন করতে হবে, নতুন কিট দরকার হবে।’

ড. বিজন ও ড. আকরাম বলছিলেন, ‘ব্রিটেনে শনাক্ত নতুন স্ট্রেইনের অস্তিত্ব বাংলাদেশে আছে কিনা, তা জানার জন্যে ‘থ্রি-জিন’ (তিনটি জিন এক সঙ্গে) পরীক্ষা করতে হবে। এই থ্রি-জিনের একটি জিন ‘এস-জিন’, যা স্পাইক প্রোটিনকে সনাক্ত করে। বাকি দুটো জিন হচ্ছে ওআরএফ-১এবি এবং এন-জিন। বাংলাদেশের আটি পিসিআরে থ্রি জিন পরীক্ষার সুযোগ না থাকায় নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত করা যাবে না। এখন বাংলাদেশেকে জরুরি ভিত্তিতে থ্রি জিন পরীক্ষার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। প্রতি ১০০টি কোভিড-১৯ পরীক্ষার কমপক্ষে পাঁচটি সিকোয়েন্সিং করতে হবে। এটা করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ লন্ডন ও কেন্ট অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হয়েছে। এ অঞ্চলে বহুসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন। তারা নিয়মিত বাংলাদেশে যাতায়াত করছেন। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে নতুন স্ট্রেইনটি ইতোমধ্যে চলে এসেছে কিনা তাও ভেবে দেখার বিষয়।’

‘নতুন স্ট্রেইন শনাক্তে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ব্রিটেনে প্রথমে থ্রি-জিন আরটি-পিসিআর স্ক্রিনিং ও পরে ভাইরাসের সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে। ‘থ্রি জিন’ আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় দেখা গেছে ‘যেসব নমুনায় এস-জিন নেগেটিভ আসছে এবং বাকি দুটো জিন পজিটিভ আসছে, সেসব নমুনা সিকোয়েন্সিং করে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই নতুন স্ট্রেইন ভাইরাসটি পাওয়া যাচ্ছে’ যোগ করেন ড. আকরাম।

ড. বিজন বলছিলেন, ‘ভাইরাসের চরিত্রই এমন সে বারবার নিজেকে পরিবর্তন করে। উহানে শুরুর সময়ের যে করোনাভাইরাস আর এখনকার সারা পৃথিবীর করোনাভাইরাস এক নয়। বারবার পরিবর্তন হয়েছে। ব্রিটেনে শনাক্ত নতুন স্ট্রেইনের ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন হয়েছে। স্পাইক প্রোটিনের লোকেশন বা স্থান সংখ্যা দিয়ে নিরূপণ করা হয়। নতুন স্ট্রেইনের স্পাইক প্রোটিনের ১৭ টি স্থানে মিউটেশন বা পরিবর্তন শনাক্ত হয়েছে। সাধারণত এক সঙ্গে এত ব্যাপক সংখ্যক পরিবর্তন হয় না, এক্ষেত্রে যা হয়েছে।’

ড. আকরাম বলছিলেন, ‘ব্রিটেনে শনাক্ত নতুন স্ট্রেইনে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের ১৭টি স্থানে মিউটেশন বা পরিবর্তনের মধ্যে একটি পরিবর্তনের হয়েছে প্রোটিনটির ৬৮১তম স্থানে (পি-৬৮১-এইচ)। বাংলাদেশে নতুন স্টেইনের যে তথ্য জানা গেছে তাতে দেখা যায় সেখানেও স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন বা মিউটেশন হয়েছে ৬৮১ তম স্থানে (পি-৬৮১-আর)। ব্রিটেন এবং বাংলাদেশের এই নতুন স্ট্রেইন দুটিতে মিউটেশন বা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে স্থানিক বা লোকেশনে মিল থাকলেও, অমিল রয়েছে প্রোটিনের এমাইনো এসিডের পরিবর্তনে। যেমন: ব্রিটেনে যেখানে মিউটেশনের কারণে নতুন এমাইনো এসিডটি হচ্ছে হিস্টিডিন, সেখানে বাংলাদেশে তা হচ্ছে আরজিনিন এমাইনো এসিড। বিভিন্ন ধরনের এমাইনো এসিড দিয়ে তৈরি হয় একটি প্রোটিন। সুতরাং এমাইনো এসিডের ভিন্নতার কারণে প্রোটিনের পরিবর্তনেও ভিন্নতা দেখা দিতে পারে। তবে, এই অমিল সত্ত্বেও বাংলাদেশকে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। কারণ মিউটেশন বা পরিবর্তনটি হয়েছে প্রোটিনের একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, যে স্থানটি স্পাইক প্রোটিনের কার্যকারিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। যুক্তরাজ্যের অতিসংক্রমণশীল এই নতুন স্ট্রেইন বাংলাদেশে চলে এসেছে তা হয়ত বলা যাচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশ ঝুঁকিমুক্ত নয়। কারণ বিমানযোগাযোগ অব্যাহত আছে।’

১৮ ডিসেম্বর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নতুন স্ট্রেইন শনাক্তের ঘোষণা দেন। দেশটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলে দেখা যায় অত্যন্ত দ্রুত গতিতে সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। সেটা পরীক্ষা করতে গিয়েই নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হয়। নতুন স্ট্রেইন পূর্বের চেয়ে শক্তিশালী কিনা এ বিষয়ে ড. বিজন ও ড. আকরাম বলছিলেন, ‘সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা এবং রোগাক্রান্ত করার ক্ষমতা, এ দুটো দিয়ে ভাইরাসের শক্তি পরিমাপ করা হয়। এখন পর্যন্ত যে গবেষণা তাতে প্রমাণ পাওয়া গেছে করোনার নতুন স্ট্রেইন ৭০ শতাংশ বেশি গতিতে ছড়ায়। বেশি শক্তিশালী কি না, তা এখনও প্রমাণিত নয়। গবেষণা চলছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে জানা যাবে। যেহেতু অল্প সময়ে অধিক সংখ্যক মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে, ঝুঁকি পূর্বের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।’

নতুন স্ট্রেইনে ভ্যাকসিন কার্যকর কি কার্যকর না সেটা নিয়ে যে আলোচনা চলছে, সে বিষয়ে ড. বিজন বলছিলেন, ‘ভাইরাসের ১৭টি পরিবর্তন হয়েছে স্পাইক প্রোটিনে। সব ভ্যাকসিনই স্পাইক প্রোটিনকে টার্গেট করে তৈরি করা হয়েছে। এতে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে কি না, একটা দুশ্চিন্তা তৈরি হচ্ছে। ফাইজার, মাডার্নার অনুমোদন পাওয়া ভ্যাকসিন, অনুমোদনের অপেক্ষমান ভ্যাকসিন, কোনোটিই এখন পর্যন্ত পরীক্ষায় প্রমাণিত নয় যে, করোনার নতুন স্ট্রেইনের ক্ষেত্রে কার্যকর কি কার্যকর না। গবেষণা চলছে, জানা যাবে আরও ৭-১০ দিন পর।’

করোনাভাইরাসের এই পরিবর্তনে নতুন করে বহুবিধ প্রশ্ন সামনে এসেছে উল্লেখ করে ড. আকরাম বলছিলেন ‘যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে, করোনার নতুন স্ট্রেইনে তারা নিরাপদ কি না তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। পূর্বের গবেষণা ছিল তারা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। আক্রান্ত হলেও এই বয়সীদের ঝুঁকি ছিল খুব কম। এই বয়সীদের উপর কোনো ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হয়নি। আরও সরাসরি বললে ১৮ বছর বয়স পর্যন্তদের জন্যে কোনো ভ্যাকসিন নেই। যদি নতুন স্ট্রেইনে তাদের ঝুঁকি প্রমাণিত হয়, তবে ভ্যাকসিন নতুন করে ট্রায়াল করতে হবে। ১-১৮ বছর বয়সীদেরও এখন খুব সতর্ক থাকা জরুরি।’

করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন কতটা উদ্বেগ তৈরি করেছে, তা বোঝা যায় ব্রিটেনের দিকে দৃষ্টি দিলে। ৫০টির বেশি দেশ ইতোমধ্যে ব্রিটেনের সঙ্গে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ করেদিয়েছে। তার আগেই অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্কে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন স্ট্রেইন। নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হয়েছে ভারতেও।

‘ব্রিটেন থেকে যাওয়া যাত্রীদের বাংলাদেশ প্রথমে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা বলছে। এতে কোনো কাজ হবে না। নতুন করে যে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের সিদ্ধান্ত, তা প্রশংসনীয়। তবে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই ঝুঁকিতে পড়ে গেছে কিনা, সেটা চিন্তার বিষয়। কোভিড নেগেটিভ সনদ নিয়েই ইংল্যান্ড থেকে টোকিওতে গিয়েছে যাত্রীরা, সেখানে নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশকে এখন থ্রি জিন পরীক্ষার কিট সংগ্রহ করতে হবে, স্ক্রিনিং ও সিকোয়েন্সিং করতে হবে। আতঙ্কিত নয়, ভয়াবহতার গুরুত্ব উপলদ্ধি করে সতর্কতা জরুরি। সতর্কতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া দরকার মাস্ক ব্যবহার। যা শতভাগ নিশ্চিত করা দরকার। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন কবে-কিভাবে, কত মানুষ পাবে তা নিশ্চিত নয়। ফলে ভ্যাকসিনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার মাস্কে’, বলছিলেন ড.বিজন ও ড. আকরাম।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago