স্বাস্থ্য খাতের মহামারির বছর
‘এতদিন ধরে আমরা যা বলে আসছি, আজ আর সেটা বলতে পারছি না। আমরা তিন জন রোগী পেয়েছি।’
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের ঘোষণা দিতে গিয়ে আইইডিসিআরের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ঠিক এই কথাগুলোই বলেন। এরপর থেকেই সবকিছুতে পরিবর্তন আসতে থাকে। এই পরিবর্তন সম্ভবত চিরদিনের জন্য।
এরপর থেকে দেশে বাড়তে শুরু করে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ, মৃত্যু। প্রতিদিন টালি খাতায় হিসাব বেড়েই চলেছে। কোভিড-১৯ আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছে।
অনিশ্চয়তা, সমন্বয়হীনতা, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে বৈষম্য, দুর্নীতি এবং লজিস্টিক ও জনবলের অভাব দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। দেখিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় কতটা নাজুক।
ওষুধ ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ জরুরি অবস্থায় আমারা যেটা পেয়েছি সেটা হলো— দেশের ত্রুটিযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সবার সামনে উন্মোচিত হয়েছে।’
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষদিকে চীনের উহান শহরে প্রথম শনাক্ত হয় করোনাভাইরাস। এরপর থেকে এই ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে বিশ্বব্যাপী ১৮ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সাড়ে সাত হাজারের বেশি মানুষ।
ভাইরাসটি বিপর্যস্ত করে তুলেছে সারা পৃথিবীর মানুষের জীবন ও জীবিকা। এরই মধ্যে সম্প্রতি জানা গেছে, যুক্তরাজ্যে ভাইরাসটির নতুন স্ট্রেইন পাওয়া গেছে, যা ‘আরও বেশি সংক্রামক’। ফলে, ইউরোপের দেশগুলো তাদের সীমান্ত বন্ধ করতে এবং অনেক দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
গত মার্চে দেশে করোনা মহামারি আঘাত হানলে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) অভাব এবং নিম্নমানের পিপিইর বিস্তর তথ্য প্রকাশ পায়। এতে করে সাহস হারান করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখযোদ্ধা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। নিম্নমানের পিপিই বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখার কারণে অন্তত এক ডজন চিকিৎসককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রথমদিকে, (সরকার) ভুয়া (নিম্নমানের) পিপিইর বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করেছিল। এই সমস্যা সমাধানের কোনো চেষ্টা করা হয়নি।’
তিনি জানান, গত ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১১২ জন চিকিৎসক মারা গেছেন।
তিনি বলেন, ‘এই মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নিজেদের জীবন পর্যন্ত বাজি রাখলেও চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের যথাযথ স্বীকৃতি পাননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুরো কোভিড-১৯ বিষয়ক পরিকল্পনা করেছে আমলারা এবং মূলত এ কারণেই এত বিশৃঙ্খলা।’
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মাত্র একজন চিকিৎসকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
করোনার ভুয়া পরীক্ষা কেলেঙ্কারি
করোনা নির্মূলে পুরো পৃথিবীতেই জোড় দেওয়া হয় পরীক্ষার ওপর। করোনা নেগেটিভ সনদ ছাড়া রোগীদের ফিরিয়ে দিতে শুরু করে হাসপাতালগুলোও। বিনা চিকিৎসায় মারা যান অনেক রোগী।
গত ২ জুন সিলেটের ছয়টি হাসপাতালে ঘুরে শেষ পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যান ৬২ বছর বয়সী মনোয়ারা বেগম। কোনো হাসপাতালই তাকে ভর্তি করেনি। তার মতো এমন বিনাচিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে আরও অনেকেরই।
২৯ মার্চ থেকে সারাদেশে করোনা পরীক্ষা সুবিধা বাড়ানোর ঘোষণা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বর্তমানে এই সুবিধা বেড়ে মোট ১১৪টি আরটি-পিসিআর, ২৪টি জেন-এক্সপার্ট এবং ২৯টি র্যাপিড অ্যান্টিজেনভিত্তিক পরীক্ষার ল্যাব রয়েছে।
সুবিধা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন পরীক্ষার পরিমাণ যখন বাড়ছিল তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২৯ জুন থেকে করোনা পরীক্ষার ওপর ফি ধার্য করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এর সঙ্গে জুলাইয়ের শুরুর দিকে যুক্ত হয় রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেড এবং জেকেজি লিমিটেডের প্রায় ৪০ হাজার ভুয়া কোভিড-১৯ সনদ দেওয়ার অভিযোগ।
দেশে করোনা সংক্রমণের প্রায় এক বছর হতে চললেও এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার।
জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির (এনটিএসি) সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যদি হাসপাতালগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ করা যেত, তাহলে আরও অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব হতো।’
দেশজুড়ে আইসিইউ’র অসম বণ্টনের কারণে বয়স্ক ও ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের চিকিৎসা একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালেও করোনা চিকিৎসা শুরু হলেও চিকিৎসা ব্যয় ছিল সর্বসাধারণের নাগালের বাইরে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন দিকে সরকারের ব্যর্থতা দেখতে পেলেও এতে দ্বিমত পোষণ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা) অধ্যাপক সেব্রিনা ফ্লোরা।
তিনি গত সোমবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ পুরো বিশ্বের কাছেই একটি অজানা চ্যালেঞ্জ। আমাদের সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু তারপরও এই ভাইরাসটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায়নি। শূন্য থেকে শুরু করে এখন আমাদের ১৬৭টি কোভিড-১৯ পরীক্ষার ল্যাব রয়েছে। এগুলো আমাদের বড় সাফল্য।’
সমন্বয়হীনতা
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় শুরু থেকেই ভুল সিদ্ধান্ত, দেরিতে ব্যবস্থা নেওয়া এবং বিভ্রান্ত চিন্তার কারণে তিন মাসের বেশি সময় পাওয়ার পরও নিজেদের গোছানোর প্রস্তুতি নিতে পারেনি সরকার।
শুরু থেকেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন, করোনা মোকাবিলার জন্য তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। বিশেষজ্ঞদের মতে, তারা ‘জনগণকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে’।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত ১৫ আগস্ট বলেন, করোনাভাইরাস বাংলাদেশ থেকে এমনিতেই চলে যাবে। ‘ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হবে কি না জানি না। কোভিড-১৯ এমনিতেই বাংলাদেশ থেকে চলে যাবে।’
এর আগে, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী।’
এসব মন্তব্য এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ের স্পষ্ট অভাব প্রায় প্রতিদিন প্রকাশ হতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত বিমানবন্দর বন্ধ রাখা, প্রবাসী শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন এবং দেশে পুরোপুরি লকডাউন দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে সরকার বাধ্য হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জরুরি ব্যবস্থা নিতে বিলম্বের কারণ।
কোয়ারেন্টিন নিয়েও সরকারের সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ার মতো। মার্চ থেকে আগস্টের মধ্যে দুই লাখের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশে আসেন। যখন সারা পৃথিবীতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন তারা দেশে ফেরেন। কিন্তু, এই প্রবাসফেরত বাংলাদেশিদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে না রেখেই বাড়িতে যেতে দেয় সরকার।
বেশ কিছু দেশ আকাশপথে যোগাযোগ পুনরায় চালু করলে কয়েক হাজার প্রবাসী শ্রমিক করোনা পরীক্ষার সনদ না পেয়ে চাকরি হারানোর ভয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েন।
গণপরিবহন বন্ধ না করেই ২৬ মার্চ থেকে লকডাউনের ঘোষণা দেয় সরকার। ফলে লাখো মানুষ ভাইরাস সংক্রমণের ভয় উপেক্ষা করেই ঢাকা ছাড়েন।
এরপর পর্যায়ক্রমে লকডাউনের মেয়াদ বাড়াতে থাকে সরকার। যার স্পষ্ট প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতে।
প্রথম কয়েক মাস করোনা সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের মতো শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে জুলাই-আগস্টে ঈদুল আজহার সময় ঢাকা থেকে নিজ নিজ জেলায় যাওয়া মানুষের ভিড় সামলানোর ব্যবস্থা করতে না পারায় সারাদেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এরপরও নিরাপত্তা নির্দেশনা অনুসরণ না করেই কয়েক হাজার পোশাকশ্রমিক ঢাকায় ফিরে আসেন।
অধ্যাপক এহতেশামুল হক বলেন, ‘চীন যখন ভাইরাসের সংক্রমণে কাবু, তখন আইইডিসিআর বলেছিল, “আমরা প্রস্তুত”। কিন্তু, গবেষণা সংস্থা হিসেবে তাদের এমনটা বলার কথা ছিল না। (২০২০ সালের) মাঝামাঝি সময়ে, মিডিয়া এবং অন্যদের চাপে পড়ে সরকার আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নেয়।’
অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমানের মতে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এক হয়ে কাজ করেনি। তবে অধ্যাপক ফ্লোরা বলেন, ‘এটি সবার জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। তবে, সবাই এখন বেশ প্রস্তুত।’
দুর্নীতি বনাম ‘নামকাওয়াস্তে’ ব্যবস্থা
করোনা মাহামারিকালে কেনাকাটাসহ বিভিন্ন দুর্নীতির বিষয়ে ব্যাপক সমালোচনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে অপসারণ করে সরকার।
অধ্যাপক এহতেশামুল হক বলেন, ‘মহাপরিচালকের অপসারণ শুধুমাত্র নামকাওয়াস্তে নেওয়া ব্যবস্থা। দুর্নীতিতে জড়িত বাকিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কয়েক শ কোটি টাকার দুর্নীতি শুধুমাত্র অধিদপ্তরের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা দেখেছি তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিবকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। আর চিকিৎসকদের রাখা হয়েছে চাপে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল হামিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘রাষ্ট্র যখন কোনো কিছুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তখন মূল কারণটি বিশ্লেষণ করা হয় না। সম্ভবত এখানেও আমরা একই চিত্র দেখছি। এই সাবরিনা, এই শাহেদ— কেউই বিভক্ত বা একক কোনো ব্যক্তি নয়। তাদের সামনে-পেছনে কারো না কারো সংযোগ আছে। আমরা যদি এই সংযোগগুলো খুঁজে না পাই, তাহলে দুর্নীতি নির্মূলে সফল হতে পারব না।’
Comments