২০২০ সাল: আসকের প্রতিবেদন

বিচারবহির্ভূত হত্যা ১৮৮, বেড়েছে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা

করোনা মহামারির মধ্যেও বিগত কয়েক বছরের মতো ২০২০ সালেও দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ছিল বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। করোনাকালেও অব্যাহত ছিল রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনা। এ সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ১৮৮ জন নিহত হন। যার মধ্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানে ১১২ জন নিহত হয়েছেন।

করোনা মহামারির মধ্যেও বিগত কয়েক বছরের মতো ২০২০ সালেও দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ছিল বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। করোনাকালেও অব্যাহত ছিল রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা। এ সময়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ১৮৮ জন নিহত হন। যার মধ্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানে ১১২ জন নিহত হয়েছেন।

আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২০ এর পর্যালোচনায় এসব তথ্য জানায় সংস্থাটি।

দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিষয়ে আসকের তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা আগের বছরগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। করোনা মহামারির মধ্যেও নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র ছিল ২০২০-এর অন্যতম উদ্বেগের বিষয়। বছরজুড়ে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যাসহ, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটেছে।

দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সার্বিক দিক তুলে ধরতে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করে প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরে আসক।

বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন

বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে নির্যাতন, মৃত্যু নিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন কমিটির প্রশ্ন ও উদ্বেগ থাকলেও বাংলাদেশ সরকার কখনও এগুলো অস্বীকার করেছে আবার কখনও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে বলে জানায় আসক। ক্রসফায়ার ও মাদকবিরোধী অভিযানে ১৮৮ জনের নিহতের ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে (গ্রেপ্তারের পর) নিহত হয়েছেন ১১ জন। গ্রেপ্তারের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে মারা যান ৫ জন এবং গুলিতে নিহত হয়েছেন ৮ জন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুম

২০২০ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন ৬ জন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৪ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন ২ জন।

তাদের মধ্যে গত ১০ মার্চ ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর। পরদিন ১১ মার্চ ঢাকার হাতিরপুল এলাকা থেকে ‘নিখোঁজ’ হন শফিকুল ইসলাম কাজল। ‘নিখোঁজের’ ৫৩ দিন পর ৩ মে গভীর রাতে যশোরের বেনাপোল সীমান্তের ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ সংলগ্ন এলাকা থেকে কাজলকে উদ্ধারের দাবি করে বিজিবি। পরবর্তী সময়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ ডিসেম্বর জামিনে মুক্তি পান কাজল।

নারী অধিকার পরিস্থিতি

করোনা মহামারির সময়েও থেমে থাকেনি নারীর প্রতি সহিংসতা। এ সময়কালে নারী নির্যাতন, বিশেষ করে ধর্ষণ ও পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে।

ধর্ষণ

২০২০ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৬২৭ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ১৪১৩ নারী এবং ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২।

২০২০ সালে ধর্ষণের ঘটনা ও এর ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে আইন সংশোধনের দাবি ওঠে। গত ১২ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। গত ১৩ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আইনটি কার্যকর হওয়ার পরও ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ১৬০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানায় আসক।

এছাড়াও ২০২০ সালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌন হয়রানী ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ২০১ নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ নারী ও ১১ পুরুষসহ খুন হয়েছেন ১৪ জন।

পারিবারিক নির্যাতন ও যৌতুক

২০২০ সালে পারিবারিক নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ৩৬৭ নারী। নির্যাতনের শিকার ৯০ জন আত্মহত্যা করেছেন। যেখানে গত বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৪২৩ নারী। 

এছাড়াও যৌতুকের জন্য, সালিশের মাধ্যমে নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন ও অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে।

শিশু নির্যাতন

২০২০ সালে শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে ৫৮৯ শিশু নিহত হয়েছে। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৮৮।

২০২০ সালে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ১৭১৮ শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় ১০১৮ শিশু, ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন হয়রানীর শিকার হয় ২৭৯ শিশু। ২০২০ সালে বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৫২ ছেলে শিশু, বলাৎকারের পর ৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় আসক।

মতপ্রকাশের অধিকার

করোনাকালে মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করাসহ দমন-পীড়ন বেড়েছে বলে জানিয়েছে আসক। বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয়রানিমূলক মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা বেড়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সূত্রে আসক জানায়, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১২৯টি মামলা হয়েছে এবং এসব মামলায় ২৬৮ জনকে আসামি করা হয়েছে।

গত ৫ মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজধানীর কাকরাইল ও লালমাটিয়া থেকে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদকে আটক করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব)। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সমালোচনামূলক পোস্ট দেওয়ায় তাদেরকে আটক করা হয় বলে জানা যায়।

এ ছাড়া উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গী গোষ্ঠীর ভিন্নমতের প্রতি হুমকি, হামলা ও ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

সাংবাদিক নির্যাতন

করোনাকালেও স্বাধীনভাবে খবর সংগ্রহ এবং তা প্রকাশের কারণে নির্যাতন, মামলা ও গ্রেপ্তারসহ বিভিন্ন হয়রানির শিকার হয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতন, হামলা, মামলা, হুমকি ও হয়রানিসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৪৭ সাংবাদিক। তার মধ্যে ২ জন হত্যার শিকার হয়েছেন।

সভা সমাবেশে বাধা

শান্তিপূর্ণভাবে সভা সমাবেশ করা ও প্রতিবাদ জানানো নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার, যা বিভিন্ন মানবাধিকার দলিলেও সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে বলে জানায় আসক।

বিএনপি, বামজোটভুক্ত দলগুলোর সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচিতে বাধার অভিযোগ আছে। এছাড়াও জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলনরত তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের শ্রমিক এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকদের গত ৭ ডিসেম্বর ভোররাতে ঘুম থেকে তুলে লাঠিপেটা করে উঠিয়ে দেয় পুলিশ।

স্বাস্থ্য অধিকার

করোনা সংক্রমণকালে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বিদ্যমান নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের এন-৯৫ মাস্কের নামে সাধারণ মানের মাস্ক দেওয়া, পিপিই দিতে দেরি ও অনিয়মের কারণে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত অথবা অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েন।

চিকিৎসকদের অনেকে মাস্ক দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ জানালে তাদের বদলি করার মতো ব্যবস্থা গ্রহণের অভিযোগও উঠেছে।

অনিয়ম- দুর্নীতি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরস্পরকে দোষারোপ করার মতো ঘটনাও ঘটে ২০২০ সালে।

শ্রমিক অধিকার

করোনা সঙ্কটকালীন সময়ে শ্রমিকদের চাকুরি হারানো, বেতন না পাওয়াসহ নানা বঞ্চনার ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ের মধ্যে গার্মেন্টসশিল্পের ৬০ থেকে ৬৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন এবং ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ না করার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

এছাড়াও পোশাক মালিকদের সিদ্ধান্তহীনতায় সাধারণ ছুটির মধ্যেও ৫ এপ্রিল কয়েক হাজার গার্মেন্টস শ্রমিক শত শত কিলোমিটার পায়ে হেঁটে তাদের কর্মস্থলের উদ্দেশে রওয়ানা দেন। কিন্তু কর্মস্থলে এসে তারা দেখতে পান, কারখানা বন্ধ।

অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণরোধে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হলেও ছুটি পাননি চা শ্রমিকরা।

এছাড়া সীমান্ত হত্যা, করোনাকালে দেশে ফেরা অভিবাসী শ্রমিকদের হয়রানি, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা, নির্যাতন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়েও উদ্বেগ জানায় সংস্থাটি। 

মানবাধিকারবান্ধব রাষ্ট্র গঠনে আসক ১০টি সুপারিশের কথাও জানায় তাদের প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠলে দ্রুততার সাথে তা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত ও সম্পৃক্তদের বিচারের আওতায় আনা, নাগরিকদের মত প্রকাশের অধিকার খর্ব না করা, গণমাধ্যম ও নাগরিকদের মতপ্রকাশের অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য নিরসনসংক্রান্ত সনদের (সিডও) ধারা ২ এবং ১৬(গ) থেকে আপত্তি প্রত্যাহার অন্যতম।

Comments

The Daily Star  | English
Govt buckles up

Govt publishes preliminary list of those killed in July-August protests

The interim government today published a preliminary list of 726 people who died during the student-led mass protests in July and August.

42m ago