২০২০: একটি অমানবিক বছর
পুরো বিশ্বই করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। একই অবস্থা বাংলাদেশের, আমাদের। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই আমরাও আমাদের সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, মৌলিক পরিষেবা, এমনকি আমাদের জীবনের প্রতিটি দিক যতটা সম্ভব আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে রয়েছি। বাকি বিশ্বের মতোই আমরাও যেটা করতে ব্যর্থ হয়েছি সেটা হলো— চারপাশে হাজারো মানুষের মৃত্যু দেখেও আমাদের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত রাখতে পারিনি। আমাদের কাছের মানুষ ও প্রিয়জনরা চলে গেছেন কিংবা কষ্ট করেছেন। কিন্তু, তাদের সাহায্য বা সেবায় এগিয়ে যেতে পারিনি। আমরা তাদের দেখতে যেতে পারিনি, সমবেদনা জানাতে পারিনি। এটা আমাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। সামাজিক বন্ধন বিচ্ছিন্ন হয়ে একক মানুষ পরিবারভিত্তিক হয়ে বেঁচে আছি। ইন্টারনেটের বদৌলতে ভার্চুয়াল জগতটাই আমাদের সামাজিকতা টিকিয়ে রেখেছে।
করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন মন্দা। যেসব দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেক শক্তিশালী বলে জানতাম, সেসব দেশেও লাখো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আমরা জানি না আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। জনসংখ্যার ঘনত্ব, স্বাস্থ্য সচেতনতার মান, জীবনযাপনের মান এবং দেশের মানুষের পুষ্টিমান বিবেচনায় আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, আরও খারাপ কিছুর। সাধারণত বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির ক্রোধের অবসান ঘটে। এই সময়ে মহামারি থেকে বাঁচাতে প্রকৃতি হয়তো অজানা কোনো পথে কিছু করছে বা করবে বলে ধারণা করি।
ঠিক কী কারণে আমাদের ওপর কোভিড-১৯’র ধ্বংসযজ্ঞ তুলনামূলকভাবে কম, তা একটা রহস্য। এটি কি আমাদের প্রাথমিক টিকাদান কর্মসূচি, আমাদের কৃষকদের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা, সূর্য থেকে পাওয়া ভিটামিন ডি, সব ধরনের দূষণ সঙ্গে নিয়ে আমাদের জীবন সংগ্রামের প্রভাব? কোভিড-১৯ কেন আমাদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালায়নি সে সম্পর্কে আমরা উদাসীন, জানি না এবং না জেনেই আনন্দচিত্তে বসে আছি। অন্যান্য বেশিরভাগ দেশ এ বিষয়ে গবেষণায় ব্যস্ত। তারা জানতে চায়, এই ভাইরাসে প্রকোপ থেকে বাঁচার উপায় এবং সেই সঙ্গে এখন যে এই ভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনের কথা শুনতে পাচ্ছি তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের উপায়।
এই মুহূর্তের প্রশ্ন হলো— আমরা কোন শিক্ষা নিয়ে নতুন বছরে যাচ্ছি?
সর্বপ্রথম এবং আবশ্যিকভাবে একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। জনগণের জন্য কম খরচে এবং নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জনস্বাস্থ্য অবকাঠামোতে সামগ্রিক পরিকল্পনা ও পরিবর্তন প্রয়োজন। বাহ্যিক অবকাঠামো বিচারে দেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্য কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার অবস্থানে আমরা রয়েছি। আমাদের ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৩ হাজার ৫০০টি কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক, উপজেলা পর্যায়ে ৪২১টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা পর্যায়ে ৬৪টি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল, বিভাগীয় সদরে ৩৫টি বিশেষায়িত হাসপাতালসহ বড় বড় হাসপাতাল রয়েছে। এর সঙ্গে আরও রয়েছে পাঁচ হাজার ৩২১টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক, নয় হাজার ৫২৯টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ১০৬টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (সরকারি ৩৬টি এবং বেসরকারি ৭০টি)। ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে এগুলো হয়তো পর্যাপ্ত না। কিন্তু, আমাদের মতো একটি দেশের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা তৈরির জন্য এগুলো বেশ শক্তিশালী ভিত।
আমরা বড়ভাবে পিছিয়ে আছি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে। এর জন্য নজর দেওয়া জরুরি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবলের দিকে, শুধুমাত্র ভবন নির্মাণ আর সরঞ্জামের দিকে নয়। চিকিৎসকদের কর্ম এলাকায় রাখতে আমাদের সরকারের যে প্রচেষ্টা সে সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। কেন সরকারের এই চেষ্টা সফল হচ্ছে না, সে সম্পর্কেও জানি। তবে, করোনা মহামারিকালে আমরা আমাদের সম্মুখযোদ্ধা চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের অঙ্গীকার ও দায়িত্বশীলতার সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারা দেখেছি। আমাদের এটা ধরে রাখা প্রয়োজন।
আমরা যদি ২০২১ সালে কার্যকরভাবে এই মহামারি মোকাবিলা করতে চাই এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী প্রস্তুত থাকতে চাই, তাহলে অবকাঠামোর ওপর দৃষ্টি আটকে না রেখে সামগ্রিকভাবে সেবার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এর জন্য আমরা কীভাবে স্বাস্থ্য খাত পরিচালনা করব, কীভাবে চিন্তা করব, কীভাবে বাজেট করব, কীভাবে ব্যয় করব এবং কীভাবে আমাদের চিকিৎসক, নার্স, বিশেষজ্ঞ ও টেকনিক্যাল কর্মীদের মূল্যায়ন করব, তার পরিকল্পনা ও পরিবর্তন প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান সংকট সামাল দিতে গিয়ে দুর্নীতি ও অপচয়ের অনেক নজির তৈরি হয়েছে। যথাযথভাবে সবাইকে ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হবে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দুর্নীতি, অপচয়, অপব্যবহার এবং অব্যবস্থাপনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারি না। আমাদের উচিত এখনই এসবের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
আমাদের দ্বিতীয় শিক্ষাটি শিক্ষা খাত নিয়ে। মহামারিটি এরই মধ্যে বিদ্যমান ডিজিটাল বিভাজন আরও বাড়িয়ে তুলেছে। স্পষ্টতই, যারা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পেরেছেন এবং নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে অভ্যস্ত হতে পেরেছে, তারাই এই সময়ের মধ্যে কিছুটা শিখতে পেরেছে। তবে যারা পারেনি, বিশেষ করে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা, বলতে গেলে পড়াশোনার বাইরেই ছিল। তাদের জীবনের ক্যালেন্ডারের পাতায় ২০২০ একটি মুছে যাওয়া বছর।
ডিজিটাল বিভাজন তীব্রতর হয়ে উঠলেও ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আমরা বিশ্বাস করি, বর্তমানে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসরুমে বসিয়ে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি রেখে যে পাঠদান পদ্ধতি, তা ঢেলে সাজানো দরকার। ভবিষ্যতে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে প্রতিদিন এত দীর্ঘ সময়ের জন্য একত্রিত করা সম্ভব নাও হতে পারে এবং এমন পরিকল্পনা ঠিকও হবে না। অনেক শিক্ষাবিদ পরামর্শ দিচ্ছেন, বিদ্যমান ক্লাসরুমভিত্তিক পড়াশোনার সঙ্গে ডিজিটাল পদ্ধতির ‘মিশ্রণ’র।
এ জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন। প্রথমেই প্রয়োজন হবে আমাদের শিক্ষকদের নতুনভাবে প্রশিক্ষিত করা। এটি অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ এবং এখন পর্যন্ত এর জন্য নেওয়া বেশিরভাগ উদ্যোগ সফল হয়নি। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য সুসজ্জিত করতে হবে। সর্বশেষ, সফটওয়ারের মতো প্রয়োজনীয় শিক্ষামূলক উপাদান প্রস্তুত করে শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
ডিজিটাল শিক্ষার সম্ভাবনা অনেক বেশি। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে তৈরি করা আধুনিক শিক্ষা উপকরণ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সব স্তরে কীভাবে দেওয়া যেতে পারে, তা চিন্তা করুন। এ ছাড়াও, আমাদের দরিদ্র এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য শিক্ষা উপকরণ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সে সম্পর্কেও ভাবুন। আমরা যদি এটা সঠিকভাবে করতে পারি, তাহলে আমাদের দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই মানের পাঠদান নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে, তার জন্য আমাদের শিক্ষকদের আবার প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যা মোটেই সহজ কাজ নয়।
আমাদের উচ্চ শিক্ষায় যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা দরকার, তা হলো— গবেষণার ওপর জোর দেওয়া। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে আমাদের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য খুবই কম বিনিয়োগ করে। এই জায়গায় এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য অর্থায়ন শুরু করতে হবে। এটা সম্ভব কেবলমাত্র শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের সমন্বিত গবেষণার মাধ্যমে।
তৃতীয় শিক্ষাটি হলো— আমাদের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে সুশাসনের জন্য আইটি অবকাঠামোকে ব্যাপকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের ইন্টারনেটের উচ্চ গতি, কম খরচ এবং নিরবচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করতে হবে। আইটি এখন আর কোনো প্রযুক্তি, শিল্প বা সমৃদ্ধির খাত নয়। এটাই আমাদের নতুন জীবনযাত্রা। স্মার্ট ডিভাইসগুলোর সাশ্রয়ী মূল্য এবং সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এই ডিভাইসগুলোর মধ্যে যেগুলো দেশে তৈরি সম্ভব, সেগুলো উৎপাদনে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উত্সাহিত করতে হবে।
এক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও বায়োটেকনোলজি এবং এর ইন্টারফেসে বিনিয়োগ করতে হবে। ভবিষ্যতের বিপ্লব এই দুটির মিশ্রণেই হবে। আমাদের অবিলম্বে এগুলোর দিকে ঝুঁকতে হবে।
শেষ শিক্ষাটি হলো— জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আমাদের আরও বিস্তৃত এবং কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ১০ বছরের নতুন একটি জলবায়ু পরিবর্তন কর্মকৌশল কার্যকর হচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এটি যথাযথ অগ্রাধিকারগুলোই তুলে ধরবে। তবে, বাস্তবায়নের সময় অতীতের মতো একই দুঃখজনক রেকর্ডের পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পারি। বর্তমানের জলবায়ু পরিস্থিতির জন্য বিশ্বের বড় বড় দূষণকারী দেশকে আমরা দোষ দেই। তবে, নিজেদের চারপাশের দূষণকারীদেরও আমরা রোধ করতে পারি না। আমাদের নদীগুলোতে রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা হয় এবং দখল করা হয়। প্রকৃতি রক্ষা এবং এগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার কথা আমরা বলি। কিন্তু, এভাবে নদী ধ্বংস করা সম্ভবত আমাদের কথা এবং কাজের মধ্যকার ফারাকের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
আমরা যে নতুন বছর এবং নতুন দশকে প্রবেশ করলাম, তা আমাদের সম্পূর্ণ অজানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। এটি অনেকটা আমাদের শেখানোর মতো যে, কীভাবে আমাদের জীবনযাপন করতে হবে এবং আমাদের সমাজ আবার কীভাবে তৈরি করা যাবে। এটা আমাদের শেখাবে কীভাবে মানব সম্পর্কগুলো পুনর্নির্মাণ করতে হবে। আমরা হাজারো বছর ধরে যা করে আসছি, সেটাই এখন করতে হবে ভিন্নভাবে।
এই ‘নিউ নরমাল’ জীবনযাপনে আমরা কোন নতুন বিষয়গুলো রপ্ত করতে পারি? একই রাজনীতি, একই দোষারোপের খেলা, একইভাবে ‘অন্যদের সবই ভুল’, একইভাবে ‘আমরা সব জানি’, অব্যাহতভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, গুম, খুন, একই প্রক্রিয়ায় নির্বিচারে গ্রেপ্তার, একইভাবে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ এবং একইভাবে নিজের ঢোল নিজে পেটানো? যেখানে নতুন বছর নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে নতুন চিন্তাভাবনা, নতুন মনোভাব এবং নতুন মূল্যবোধ দাবি করছে, সেখানে এই একই অভ্যাসগুলো কি আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে?
আমাদের সকল পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রীতি এবং শুভেচ্ছা। বিশেষ করে শুভেচ্ছা আমাদের পাঠকদের, যারা সম্ভাব্য প্রতিটি উপায়ে সমর্থন যুগিয়ে আসছেন। আশা করি নতুন বছরটি সবার ব্যক্তি ও কর্মজীবনে সুখ এবং সাফল্য নিয়ে আসবে। ইংরেজী নববর্ষ ২০২১-এ সবার জন্যে অনেক অনেক শুভ কামনা।
মাহফুজ আনাম: দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক
Comments