ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৩ শিক্ষক নিয়োগ, বহু প্রশ্ন

Aparajeyo Bangla

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট সভায় গত ৩০ ডিসেম্বর অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে তিন প্রভাষকের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। এরপরেই বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। অভিযোগ উঠে, শিক্ষক নিয়োগে প্রশ্নবিদ্ধ সুপারিশই বহাল রেখেছে সিন্ডিকেট।

ওই তিন শিক্ষক নিয়োগে বাছাই বোর্ডের সুপারিশ নিয়ে প্রশ্ন উঠায় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুপারিশ রিভিউ (অধিকতর যাচাই) করতে কমিটি গঠন করা হয়। ১০ মাস পর জানা যায়, সুপারিশ নিয়ে ওঠা প্রশ্নের কোনো 'যৌক্তিকতা' পায়নি রিভিউ কমিটি।

অভিযোগ

স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া একজন ও ডক্টরেট (পিএইচডি) ডিগ্রিধারী পাঁচ প্রার্থীকে বাদ দিয়ে ফলাফলে চতুর্থ ও দশম প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে সুপারিশ করে বাছাই বোর্ড।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সিন্ডিকেট সভায় ওই সুপারিশ অনুমোদনের জন্য উঠে। তবে সুপারিশ নিয়ে অভিযোগ থাকায়, তা গ্রহণ না করে অধিকতর যাচাইয়ের জন্য একটি রিভিউ কমিটি করে দেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।

ওই বাছাই বোর্ডের প্রধান ছিলেন ঢাবির তৎকালীন সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ। গত জুনে দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হলে তার স্থলাভিষিক্ত হন অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল। আগের সুপারিশ 'অধিকতর যাচাই' করে সর্বশেষ সিন্ডিকেট সভায় তিনি বিষয়টি উত্থাপন করেন।

অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর বিভাগের দুটি স্থায়ী শূন্য প্রভাষক পদ পূরণের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এ পদে চাকরির আবেদন পড়ে ২৬টি। আবেদনকারীদের মধ্যে গত বাছাই বোর্ডের সভায় মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন ১৬ জন। তাদের মধ্য থেকে তিন জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে বাছাই বোর্ড।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের নিয়োগের সুপারিশ করেছে বাছাই বোর্ড। সেসময় নিয়োগের জন্য সুপারিশ পান মো. রাফিউল ইসলাম রাঙ্গা, এস এম তানজিল শাহ ও মো. আবু সায়েম খান। তাদের কারও কোনো গবেষণা প্রকাশনা নেই।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে পিএইচডি করা ড. মোরশেদা মাহবুব, যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা ড. শুভ্র প্রকাশ নন্দী, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা ড. জিনাত জেরিন হোসাইন ও ড. জান্নাতুল ফেরদৌস এবং ঢাবি থেকে পিএইচডি করা ড. শারমিন জামান ইমনকে বাদ দেয় বাছাই বোর্ড।

এ ছাড়াও, সুপারিশপ্রাপ্ত মো. আবু সায়েম খান ও এস এম তানজিল শাহর ব্যাচের স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া নাদিরা নাজনীন রাখিকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেনি বাছাই বোর্ড।

পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১৬ জনের মধ্যে রাখিই কেবল স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন। এমনকি ওই ব্যাচে জীববিজ্ঞান অনুষদের মধ্যেও প্রথম হন তিনি। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তার দুটি প্রকাশনাও রয়েছে।

নাদিরা নাজনীন রাখি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একজন প্রার্থী হিসেবে ভেতরের খবর জানি না। আমি নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী আবেদন করেছি এবং পরীক্ষা দিয়েছি। এ বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না।'

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের এক সূত্রে জানা গেছে, সিন্ডিকেট সভায় একজন সদস্য প্রশ্নবিদ্ধ সুপারিশ বহালের বিরুদ্ধে ছিলেন।

এ বিষয়ে অধ্যাপক নাসরিন আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি জেনেছি যে, আগের যা সুপারিশ ছিল সেটাই পাশ হয়েছে।'

'এটা ২০১৯ সালের বিষয়। এখন স্পষ্ট মনে নেই। আমার যতদূর মনে পড়ছে, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষক নারী। বিভাগের চেয়ারম্যানের পুরুষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে একটা প্রাধান্য থাকতে পারে। এ বিষয়ে বিভাগে খোঁজ নিলে জানা যাবে', বলেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে বাছাই বোর্ড সদস্য এবং অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাবিতা রিজওয়ানা রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন জানিয়ে পরে যোগাযোগ করতে বলেন।

এ ছাড়াও, অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামালের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যা বলছেন

নাম না জানানোর শর্তে অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিয়োগ বিতর্ককে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম যিনি হয়েছেন, যার স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে দুটি প্রকাশনা আছে, তাকে না নিয়ে অন্যদের নিয়োগ দেওয়ায় আমরা বিস্মিত। আমরা চাই, সুপারিশ পুনর্বিবেচনা করা হোক, যিনি যোগ্য তাকেই যেন নিয়োগ দেওয়া হয়।'

ঢাবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যারা আবেদন করেছিলেন তাদের মধ্যে পাঁচ জন দেশের বাইরের ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে আসা প্রার্থী। যেসব শিক্ষার্থীরা পিএইচডি করতে বিদেশে যান, পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসতে আসতে তাদের সরকারি চাকরির বয়সসীমা পার হয়ে যায়। তারা সাধারণত শিক্ষকতা ও গবেষণাতেই থাকতে চান।'

'এই যে পিএইচডি ডিগ্রীধারীদের বাদ দেওয়া হলো, এটি আমাদের শিক্ষার্থীদের একটি বার্তা দেয়। সেটি হলো- তারা দেশে ফিরে আসলে চাকরি পাবেন না। ফলে তারা কেন ফিরবেন? তারা তো চাইবেন যেভাবেই হোক বিদেশেই থেকে যেতে। এর ফলে, মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক হিসেবে পাব না', বলেন তিনি।

তিনি বলেন, 'প্রার্থীদের মধ্যে একজন স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন। তিনি বিভিন্ন ধরনের কোর্স, পরীক্ষা, ভাইভা দিয়েই প্রথম হয়েছেন। তাকে ১০ মিনিটের সাক্ষাৎকারে বাদ দিয়ে যিনি দশম হয়েছেন তাকে নেওয়া, এটা ঠিক না। দলীয় কারণে হোক, স্বজনপ্রীতি করে হোক, প্রভাবশালী কারও কারণে হোক, যদি ভালো শিক্ষার্থীকে আমরা বঞ্চিত করি তাহলে আগামী ৩০ বছর যারা পড়াশোনা করবে তাদেরকে আমরা ভালো শিক্ষক থেকে বঞ্চিত করলাম। আর খারাপ শিক্ষকরা তো ভালোদের অনুপ্রাণিতও করবে না। এটার একটা চেইন ইফেক্ট আছে। এভাবে আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নষ্ট করে ফেলছি।'

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, '১০-১৫ বছর আগে ঢাবির র‍্যাংকিং ৮০০ এর মধ্যে ছিল। এখন এক হাজারের মধ্যেও নেই। আমার ধারণা আগামীতে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। ঢাবিতে এমনিতেও ভালো মানের স্কলার খুব বেশি নেই। আত্মসম্মান বোধ নিয়ে যে কজন আছেন, তারাও আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অবসরে যাবেন। যেভাবে শিক্ষক নিয়োগ চলছে, তাতে এরপরে যে প্রজন্ম আসবে, তাদের নিয়ে আমি শঙ্কিত।'

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, 'নিয়োগ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। ডেমো ক্লাস নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মতামত নিতে হবে, তারা পড়া বোঝে কি না যাচাই করতে হবে। একটা সেমিনার দিতে হবে। শিক্ষকদের মতামত নিতে হবে। উপাচার্যের রুমে ১০ মিনিটের সাক্ষাৎকার দিয়ে শিক্ষকের চাকরি হয়ে যাওয়া মানে হলো, আমরা শিক্ষক নিয়োগকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে উপাচার্যের থাকার কথা নয়। ওই বিভাগের শিক্ষকরা থাকবেন, বড়জোর ডিন থাকতে পারেন।'

'বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি র‍্যাংকিংয়ে আনতে হয়, পড়াশোনার মান উন্নত করতে চায়, তাহলে বর্তমান শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। এটা পরীক্ষিত যে, এই বিদ্যমান ব্যবস্থায় ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছি না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০-৫০ বছর আগে যে নিয়ম ছিল, এখনও সেই নিয়মেই আছে। এখনও এসএসসি, এইচএসসি রেজাল্ট দেখা হয়। সারা পৃথিবীতে অনার্স, মাস্টার্স, পিএইচডি করে তারপর শিক্ষক হয়। আমরা মাস্টার্সেই নিয়ে নেই। পিএইচডি ডিগ্রীধারী কেউ আবেদন করলেও নেই না। উচ্চলম্ফ খেলায় যেরকম প্রথমে দড়িটাকে নিচে রেখে আস্তে আস্তে উপরে তোলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রেও একইরকম হতে হয়, দিন দিন কঠিন করতে হয়। আমরা দিনে দিনে দড়িটাকে নিচে নামাচ্ছি। এ কারণেই পড়াশোনার মানও নিচে নামছে', যোগ করেন তিনি।

পুরুষ শিক্ষক নিয়োগে বিভাগের চেয়ারম্যানের প্রাধান্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এটা তো খুবই লজ্জার বিষয়। সারা পৃথিবীতেই নারী প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। আমি একটু আগেও যুক্তরাষ্ট্রের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে পড়ছিলাম। সেখানেও নারী প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এরকম কখনও শুনিনি যে, পুরুষদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।'

উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি যা বললেন

ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বিষয়ে বাছাই বোর্ড বলতে পারবে। এরকম কিছু নিয়ে আমার বলার সুযোগ নেই।'

'আমাদের কতগুলো সংবিধিবদ্ধ বিধিমালা অনুসরণ করে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হয়। বাছাই বোর্ডে বিশেষজ্ঞরা থাকেন। তারাই পর্যালোচনা করে মূল্যায়ন করে দেন। নিয়োগের বিষয়টি কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলে আমরা সেটি খতিয়ে দেখি, সম্ভাব্য কোথাও কোনো সমস্যা রইলো কি না', বলেন তিনি।

তিনি বলেন, 'এই তিন শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যেহেতু প্রশ্ন উঠেছিল, তাই ভালোভাবেই বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে।'

আবার প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষক নিয়োগে প্রশ্নবিদ্ধ সুপারিশই বহাল রেখেছে সিন্ডিকেট। কী বলবেন?

উপাচার্য বলেন, 'বিষয়টি গত সিন্ডিকেট সভায় চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে আর কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আইনি কাঠামোর মধ্যে তা আবার পর্যালোচনা করতে হয়।'

'আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কতগুলো আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। এখানে কোনো ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি একেবারেই গৌণ। সামষ্টিক এবং আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে, নির্বাচক মণ্ডলী ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়', বলেন তিনি।

ঢাবি শিক্ষক সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি ডা. মো. রহমত উল্লাহ বলেন, 'শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাছাই বোর্ড আছে। প্রতিটি অনুষদ ও বিভাগের বিশেষজ্ঞ ও প্রতিনিধিরা সেখানে থাকেন। শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে শিক্ষক সমিতির কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। এটি শিক্ষক সমিতির কাজের মধ্যেও পড়ে না।'

'তবে কেউ যদি নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে শিক্ষক সমিতির সদস্য হন, তখন তার বিষয়ে আমরা কথা বলতে পারি', বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
Hilsa fish production in Bangladesh

Hilsa: From full nets to lighter hauls

This year, fishermen have been returning with lesser catches and bigger losses.

13h ago