ভ্যাকসিন পেতে দেরি, কত দেরি?

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ও অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানের পর্যালোচনা
ছবি: এএফপি

ভারতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনার ভ্যাকসিন অনুমোদন দেওয়া বাংলাদেশের জন্য সুসংবাদ ছিল বলেই ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু, এখন দেখা যাচ্ছে ভারত সরকার ভ্যাকসিন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যে কারণে ভ্যাকসিনপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে গেল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ও অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান।

করোনার ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ছাড়া আর কারো সঙ্গে চুক্তি করেনি বাংলাদেশ। এ ছাড়া, গ্যাভির মাধ্যমে যে ভ্যাকসিন পাওয়ার আশা করা হচ্ছে, সেই ভ্যাকসিন আগে দরিদ্র দেশ এবং যেসব দেশে সংক্রমণ-মৃত্যুর হার বেশি, সেসব দেশের পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেক্ষেত্রে আমরা কবে নাগাদ ভ্যাকসিন পাব? ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কি আবারও পিছিয়ে গেলাম? একাধিক সোর্সের কাছ থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত ছিল কি না? এখন করণীয়?— এসব বিষয়ে করোনা মোকাবিলায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এবং কমিটির আরেক সদস্য, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার

ভ্যাকসিন রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা আমাদের জন্যে খুবই খারাপ খবর বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের ভ্যাকসিন পেতে অনেক দেরি হবে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন হয়তো আমাদেরকে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। আসলে ভারত রাষ্ট্রটা খুব অনির্ভরযোগ্য একটা রাষ্ট্র। এমনটিই বোঝা যাচ্ছে। ভারত সরকার তো জানত যে, সেরামের ভ্যাকসিন পাওয়ার চুক্তি হচ্ছে। এমন তো নয় যে, ভারত জানত না। সবকিছু করার এতদিন পরে ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দিলো। আমাদের সঙ্গে বৈরিতাসূলভ আচার-আচরণ করা হলো। জানা সত্ত্বেও ভারত সরকার এ ধরনের ব্যবহার করল। এ ধরনের আচরণ কিন্তু এবারই প্রথম না। এর আগে পেঁয়াজের বেলাতেও তারা এমন করেছে।’

‘গতকাল সংবাদটি জানার পর খুব খারাপ লেগেছে। একটা রাষ্ট্র, যখন যা ইচ্ছা তাই করল। আমাদের এখানেও তো মানুষ ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। বিষয়টি তারা আগে জানালে হয়তো আমরাও আরও অন্য জায়গায় ব্যবস্থা করতাম। ভারতের এই আচরণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও জানাতে হবে যে, তারা যা করেছে, সেটা অত্যন্ত অবিবেচনাপ্রসূত। তাদের এই আচরণে আমি ক্ষুব্ধ।’

সেক্ষেত্রে আমাদেরও ভুল ছিল কি না যে, একাধিক সোর্সের কাছ থেকে প্রাপ্তি নিশ্চিত না করে একটা সোর্সের দিকে তাকিয়ে ছিলাম?, জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এটা আংশিক সত্য যে, আমরা একটা সোর্সের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। তবে, আমাদের সোর্স কিন্তু খুব বেশি নেই। ফাইজারেরটা তো আমরা নিতেই পারব না। নানা ধরনের ঝামেলা রয়েছে। তবে, চীনাদের ভ্যাকসিনের দরজাটা যদি আমরা খুলে রাখতে পারতাম, তাহলে ভালো হতো। আমরা হয়তো তাদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে পারতাম। তবে, চীনারা নাকি আবার আমাদেরকে অফার করেছে। দেখা যাক, কী হয়।’

বর্তমানে করণীয় নিয়ে তিনি বলেন, ‘ভারতের ভ্যাকসিন যদি আমরা এখনই না পাই, পেতে দেরি হয়, তাহলে এখনই আমাদেরকে অন্য সব সোর্স খুঁজতে হবে। যাতে তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়। যত দ্রুত সম্ভব এটা করতে হবে।’

অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলছিলেন, ‘আমি আগেও বলেছিলাম যে, সহজে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে না। সরকার যেভাবে বলছে, মন্ত্রী যেভাবে বলছে, প্রতিবাদ করতে করতে তো আর পারছি না। ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমাদের বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল যে, মে-জুনের আগে ভ্যাকসিন আসবে না। এখন মনে হচ্ছে, সেই ধারণাটাই সঠিক হবে। আমাদের এখানে ভ্যাকসিন আসতে মে-জুন হতে পারে। আর ভ্যাকসিন নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব আশাবাদী ছিলাম না। নানা রকম কথাবার্তা আসছে যে, বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও সংক্রমিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।’

একাধিক সোর্সের কাছ থেকে ভ্যাকসিনপ্রাপ্তি নিশ্চিত না করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এর কারণ ছিল, এই ভ্যাকসিনটার দাম। দ্বিতীয়ত আমরা প্রথম থেকেই গ্লোবাল বিজনেস অ্যান্ড পলিটিকসের কথা বলেছিলাম। সেটাই হলো। তবে, চীনের ভ্যাকসিনের সুযোগটা ছিল। তারা এখানে ফ্যাক্টরি করতে চেয়েছিল। আমরা দেইনি।’

এখন আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করণীয় নেই বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান। ‘কারণ অন্যান্য যেই ভ্যাকসিনগুলো বাজারে আছে, সেগুলোর কোল্ড চেইন আমাদের দেশে মেইন্টেইন করা সম্ভব না। আমরা তো নির্ভরশীল। এখন যাদের ওপর আমরা নির্ভরশীল, তাদের মর্জির ওপরেই নির্ভর করবে। আমরা যাই বলি আর যাই করি, তাতে কিছু আসে যায় না’, বলেন তিনি।

‘চুক্তি সইয়ের সময় তো ভারতীয় হাইকমিশনারও এসেছিলেন। তাহলে ভারত সরকার তো বিষয়টি জানত। ভারত তাদের জনগণের ভ্যাকসিন দেওয়া আগে নিশ্চিত করতে চাইছে বলেই নিষেধাজ্ঞা দিলো। এখানে আমাদের আর কী করা’, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা ভ্যাকসিনের ভারতীয় সংস্করণ ‘কোভিশিল্ড’ চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া পর এটির তিন কোটি ডোজ সংগ্রহের জন্য গত ৫ নভেম্বর ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (এসআইআই) ও বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে সরকার। ট্রায়াল শেষে পরিস্থিতি বিবেচনায় গতকাল রোববার ভারতের কেন্দ্রীয় ড্রাগ কর্তৃপক্ষ ড্রাগস কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়া (ডিসিজিআই) সেরাম ইনস্টিটিউটের কোভিশিল্ড এবং ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিনের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদনের দিয়েছে।

ভারতে ভ্যাকসিন অনুমোদন দেওয়ায় বাংলাদেশও ভ্যাকসিনপ্রাপ্তিতে আরও অগ্রসর হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু, গতকাল রোববার বার্তা সংস্থা এপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদার পুনাওয়ালা বলেছেন, ‘ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ভ্যাকসিনটি জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু, তারা শর্ত দিয়েছে যে দেশটিতে ঝুঁকিতে রয়েছেন এমন জনগোষ্ঠীর জন্যে ভ্যাকসিন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সেরাম ইনস্টিটিউট তা রপ্তানি করতে পাবে না। খোলা বাজারে ভ্যাকসিন বিক্রি না করার শর্তও দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে আমরা শুধু ভারত সরকারকে ভ্যাকসিন দেবো।’

ভারতের এই নিষেধাজ্ঞার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভ্যাকসিন পাওয়া কয়েক মাস পিছিয়ে যেতে পারে বলেও এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন:

ভ্যাকসিন রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা

ভারতে কোভিশিল্ড, কোভ্যাক্সিন অনুমোদন

ভারতে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের অনুমোদন বাংলাদেশের জন্যেও সুসংবাদ

ভারতে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ব্যবহারের পক্ষে বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ

যুক্তরাজ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন

যুক্তরাজ্যে ৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হতে পারে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন বিতরণ

যুক্তরাজ্যে প্রথম করোনার ভ্যাকসিন পেলেন ৯০ বছরের নারী

চীনের ভ্যাকসিন কবে আসবে ‘নিশ্চিত নয়’

অনুমোদন পেল ফাইজারের ভ্যাকসিন

‘অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন পেতে কমপক্ষে আরও ২-৩ মাস সময় লাগবে’

ভারতের সঙ্গে ভ্যাকসিন বিষয়ে আলোচনা চলছে: ফাইজার

করোনার নকল ভ্যাকসিন আশঙ্কায় ইন্টারপোলের সতর্কতা

Comments

The Daily Star  | English

Please don't resign: An appeal to Prof Yunus

Every beat of my patriotic heart, every spark of my nation building energy, every iota of my common sense, every conclusion of my rational thinking compels me to most ardently, passionately and humbly appeal to Prof Yunus not to resign from the position of holding the helm of the nation at this crucial time.

3h ago