নিভৃতেই অবসান মাশরাফি যুগের?

Mashrafe retirement
ছবি: ফিরোজ আহমেদ

২০০১ সালে প্রায় কিশোর বয়সে অভিষেকের পর পারফরম্যান্সের কারণে কখনই বাদ পড়তে হয়নি মাশরাফি বিন মর্তুজাকে। প্রথমবার বাদ পড়লেন যখন, তখন তার ক্যারিয়ারে বাজছে বেলা শেষের গান। নেতা, জেদি, অনুপ্রেরণাদায়ী, লড়াকু,  নিবেদনের অন্য নাম হয়ে গত দুই দশক বাংলাদেশের ক্রিকেটে আলো ছড়িয়েছেন তিনি। সেই যাত্রা যেন শেষ হলো বেশ নিভৃতে। শেষ হয়েও কি হলো না সেও অবশ্য কৌতূহলের বিষয়। তবে ৩৭ পেরুনো মাশরাফি বাংলাদেশের বাস্তবতায় আবার জাতীয় দলে ফিরতে পারবেন এমন ভাবনা রীতিমতো বাড়াবাড়ি।

একটু সাহস করে বলে দেওয়াই যায় ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ে দিয়ে শুরুর পর ২০২০ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ বোধহয় খেলে ফেলেছেন দেশের সফলতম অধিনায়ক।

অধিনায়কত্বের শেষ হিসেবে গেল বছর সিলেটে সে সিরিজে বিপুল সম্মান, ভালোবাসা পেয়েছিলেন মাশরাফি। নেতৃত্ব ছাড়লেও মাঠের খেলা চালিয়ে  যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে একটা ‘কিন্তু’ রেখে দিয়েছিলেন নিজেই। তাকে প্রাণভরে বিদায়ী ভালোবাসা দিতে গিয়েও তাই খেদ থেকে গিয়েছিল লোকের।

২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি দিনটা আলাদা কিছু নয়। বরং বেশ সাদামাটা। অপরাহ্ণের মিষ্টি রোদে মিরপুরের বিসিবি একাডেমি ভবনের সামনে মাশরাফিকে বাদ দেওয়ার ‘কঠিন’ সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দেন দুই নির্বাচক। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু আর হাবিবুল বাশার সুমনেরও মাঠ থেকে বিদায় নিতে না পারার হাহাকার আছে। তাদের সঙ্গে এখানে অবশ্য তফাৎ আছে মাশরাফির। মাঠ থেকে বিদায়ের আকুতি নিশ্চয়ই তাদের ছিল, মেটায়নি তখনকার কর্তৃপক্ষ। মাশরাফির যে নিজেরই তেমন ইচ্ছে নেই।

তার কথা স্পষ্ট, তিনি খেলা চালিয়ে যাবেন। পারফরম্যান্সের বিচার করে তাকে দলে নেওয়া বা না নেওয়ার ভার নির্বাচকদের।

সেই কঠিন ‘ভার’ অবশেষে ‘সম্মিলিত সিদ্ধান্তে’ নামিয়ে ফেলেছেন নির্বাচকরা।  বাদ দেওয়ার ব্যাখ্যা যেভাবে দিয়েছেন তাতে খুব বেশি প্রশ্নবিদ্ধও হতে হয়নি তাদের। টিম ম্যানেজমেন্ট আর মাশরাফিকে আগামীর পরিকল্পনায় দেখছে না। সামনে প্রচুর খেলা, আছে ২০২৩ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। জাতীয় দলের দরজার কড়া নাড়ছেন বেশ কজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ।

৩৮ বছরে পা দেওয়া মাশরাফি বিশ্বকাপের বছরে চল্লিশ পেরুবেন। একজন পেসারকে নিয়ে পৃথিবীর কোন দলই এরকম বয়েসে আর বাজি ধরবে না। তবু মাশরাফির পারফরম্যান্সের গ্রাফ উর্ধ্বমুখি থাকলে তাকে বিবেচনার বাইরে রাখা সহজ হতো না। বিশ্বকাপে ৮ ম্যাচে ১ উইকেটের চূড়ান্ত ব্যর্থতা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে  ৩ ম্যাচে ৪ উইকেট দিয়ে পুষাতে পারেননি। তাতেই মাশরাফিকে ‘ছাড়া’ এগিয়ে যাওয়ার পথ ঠিক করে ফেলে বিসিবি।

কয়েকটি গণমাধ্যমে মাশরাফির ফিটনেস নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছেন বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন। কিন্তু চোটজর্জর শরীরকে বরাবরই মাঠের মুন্সিয়ানায় আড়াল করে গেছেন মাশরাফি। মূলত বয়সের কারণে পারফরম্যান্সের সেই ধার কমে যাওয়াতেই ফিটনেস ইস্যু খোলাসা হয়েছে বড় করে।

না হলে হাঁটুতে টেপ পেঁচিয়ে তার খেলতে নামা তো আলাদাভাবে বাহবাই কুড়িয়েছে মানুষের। হাতে সেলাই নিয়েও ম্যাচ খেলতে নেমে খবর হয়েছেন। চোট-টোটকে থোড়াই কেয়ার করা নড়াইলের দাপুটে ছেলে হয়ে গিয়েছিলেন হাল না ছাড়ার আরেক নাম।

Mashrafe retirement4

খেলোয়াড় ও অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির বাংলাদেশের ক্রিকেটে আলাদা দুই অধ্যায়ের মূলে থাকবেন। এক সময় ভঙ্গুর, আত্মবিশ্বাসহীন, নড়বড়ে একটা দলের তিনিই ছিলেন প্রধান অক্সিজেন। মাশরাফির শুরুতেই উইকেট মানেই যেন ছিল বাংলাদেশের কোন জয়ের আভাস। পারফরম্যান্স দিয়ে দেশের ক্রিকেটকে অন্য একটা স্তরে নিয়ে যাওয়ার কাণ্ডারিদের একজন তিনি।

২০১৪ সালে যখন অধিনায়কত্ব পেলেন অগোছালো, টানা হারে বিপর্যস্ত এক দল পড়ল তার ঘাড়ে। নিজের সহজাত ব্যক্তিত্ব আর খোলামেলা মন নিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া একেকটা নামকে আবার এক সুতোয় বাধলেন,  নিংড়ে দেওয়ার আগুন ধরিয়ে দিলেন সবার বুকে। তার সেই নতুন ব্র্যান্ড ২০১৫ বিশ্বকাপেও তাক লাগিয়ে দিল দুনিয়াকে। এরপরেও চলল কেবল উপরের উঠার অভিযান। বড় বড় জয় তখন অনেকটা হরহামেশা ব্যাপার। ‘মিনোস’ তকমা শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলল যেন বাংলাদেশ।

২০১৯ বিশ্বকাপে আশা তাই ছিল আকাশচুম্বী। সেই আশার জায়গা যে নিজেই বানিয়েছিলেন তিনি। তা পূরণ না হওয়াতেই বোধহয় মাশরাফি অধ্যায়ের মধুর সমাপ্তির পথ হয়ে পড়ে কণ্টকময়।

বাস্তবতা হলো শচীন টেন্ডুলকারকেও এক সময় থামতে হয়। ব্রায়ান লারাকে ছেড়ে যেতে হয় বাইশ গজ। তীব্র প্রভাবশালী মহেন্দ্র সিং ধোনিকেও নিভৃতে বলতে হয়েছে- ‘আলবিদা।’

বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাশরাফির মতো একজন মহাতারকার আড়ম্বরপূর্ণ বিদায় হবে। এমনটা মানুষের স্বাভাবিক চাওয়া। একটা সুন্দর বিদায়ের মধ্যে যে আছে পূর্ণতার তৃপ্তি। নতুনকে সাদরে বরণ করে নেওয়ার অগ্রসরমান চিন্তাও।

কিন্তু নানান হিসেব নিকেশের জটিলতায় মানুষের সেসব চাওয়া আর পূর্ণতা পায় না। মাশরাফি নিজে অমন বিদায় না চাইলে বিসিবির করার থাকে তো সামান্যই।

বিশ্বকাপের পর থেকেই মাশরাফির সঙ্গে বিসিবির সম্পর্ক শীতল হয়েছে। নানান মাধ্যমে জানা গেছে মাশরাফিকে তারা জাঁকজমকপূর্ণ বিদায় জানতে চেয়েছিল তারা। তিনি রাজী হননি। ওয়ানডের নেতৃত্ব ছাড়ায় জিম্বাবুয়ে সিরিজ একটা বিদায় সম্বর্ধনা পেয়েছেন। তাতে তো ক্রিকেটার মাশরাফিকে বিদায় জানানো হয়নি। মাশরাফি তার ‘ভালোবাসার ক্রিকেট’ ছেড়ে যাচ্ছেন না আপাতত। ঘরোয়া ক্রিকেটে তাকে পাওয়া যাবে। হয়ত কোনদিন সেখান থেকে বিদায় নিতে গিয়ে পাবেন আড়ম্বরপূর্ণ ভালোবাসা। সেটা হলে কিংবা না হলেও মাশরাফি বাংলাদেশের ক্রিকেটে থেকে যাবেন একজন নায়ক হয়ে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার সমাপ্তি একটা অস্বস্তি হয়ে থাকবে ঠিকই। হয়ত আগামীর কোন নায়কের জন্য উদাহরণ হয়েও থাকবে।

Comments

The Daily Star  | English

COP29 and the stakes for Bangladesh

The distribution of benefits is unequal between buyers and sellers.

3h ago