চুক্তি প্রকাশ করলেই ভ্যাকসিন ‘ধোঁয়াশা’ কেটে যাবে
‘বাংলাদেশ কবে ভ্যাকসিন পাবে?’ এই প্রশ্নের এখনো কোনো ‘যথাযথ’ উত্তর পাওয়া যায়নি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ যথাসময়েই ভ্যাকসিন পাবে। কিন্তু, সরাসরি ভারতের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে তা নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। চুক্তিটা বাণিজ্যিক নাকি জিটুজি (সরকার থেকে সরকার), এ নিয়েও রয়েছে বিপরীত বক্তব্য।
ভ্যাকসিন কবে আসবে, তা নিয়ে এত বিভ্রান্তি কেন?, আগে নানা ধরনের কথা বলা হয়েছিল। যেমন: ‘ভারত যখন ভ্যাকসিন পাবে, আমরাও তখন পাব’; ‘জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে আমরা ভ্যাকসিন পাব।’ কিন্তু, গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিব বলেছেন, ‘আমরা চুক্তি অনুযায়ী টিকা পাব’; ‘চুক্তির ভিত্তিতে কথা বলছি’। এখন সেই চুক্তিতে কী আছে, সেটাও তো পরিষ্কার করে বলা হয়নি। জনমনে প্রশ্ন— কী আছে চুক্তিতে?, করোনা মোকাবিলায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির ও জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আরেক সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘(স্বাস্থ্য) মন্ত্রণালয়কে জিজ্ঞাসা করেন, তারা জিটুজি বলছে, বেক্সিমকো বলছে বাণিজ্যিক, এটা আসলে কী? আর সবমিলিয়ে গতকাল অনেক বিভ্রান্তি ছিল। এখন কিছুটা পরিষ্কার হলেও যে বিভ্রান্তি আছে, তা নিয়ে মন্ত্রণালয়কে জিজ্ঞাসা করেন। বেক্সিমকোর এমডি নাজমুল হাসান পাপন তো বলেছেন যে, তারা যে চুক্তি করেছেন, সেই অনুযায়ী সেরাম ইনস্টিটিউট ভ্যাকসিন দিতে বাধ্য। এখন চুক্তির পর যদি সেরামের সিইও বলেন যে, তারা এখন দিতে পারবে না, তাহলে তো তাদের বিরুদ্ধে কেস করা যাবে। আর বেক্সিমকো তো বলেছেই যে, ভ্যাকসিনটা আমরা সময় মতোই পাব।’
আগে ভ্যাকসিন আসা নিয়ে নানা ধরনের কথা বললেও গতকাল বলা হয়েছে ‘আমরা চুক্তি অনুযায়ী পাব’। কিন্তু, চুক্তির বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। চুক্তিটা কী?, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন যে, চুক্তিটা আসলে কী? সেটা আমাদেরকে জানানো যাবে কি না। অনেক সময় চুক্তিটা প্রকাশ করে না।’
কিন্তু, যেহেতু এটা একটা জাতীয় সংকট, তাই চুক্তিটার বিষয়ে পরিষ্কার করে বলা উচিত ছিল বলেই মনে করেন অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। ‘সরকারকে এটা নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে যে, আপনারা এটা পরিষ্কার করেন। এখন আমাদের ওষুধ প্রশাসন এটাকে অনুমোদন দিয়েছে। এটা প্রয়োজন ছিল। আরেকটা বিষয়, ডব্লিউএইচও এটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে কি না। যতদূর জানি সেটা এখনো পায়নি। এগুলো কিছু বিষয় আছে। এ নিয়ে সরকার কিন্তু কিছু বলেনি। ডব্লিউএইচওর স্বীকৃতি দরকার হবে, সেটা কিন্তু সরকার বলছে না। অনেক কথাই সরকার বলছে না। সরকারকে প্রশ্ন করে বিষয়গুলো পরিষ্কার করতে হবে। আমাদের দেশে ওষুধ প্রশাসন অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু, ডব্লিউএইচও অনুমোদন না দিলে তো হবে না। কারণ, তাদের অনুমোদন ছাড়া ওই ভ্যাকসিন কেউ ব্যবহার করতে পারবে না।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভ্রান্তি মোচনে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত বলে মনে করেন এম হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক কিছুই শুনছি। এখানে যেটা হয়েছে, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটা হচ্ছে স্পিরিট। কিন্তু, ফাংশানালি চুক্তিটা হয়েছে দুইটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে (সেরাম ও বেক্সিমকো)। এক্ষেত্রে বলা যায়, ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আওতায় এই দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়টি হচ্ছে। এ কারণেই জটিলতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু, আমি মনে করি, দুই সরকারের বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত। অন্যথায়, বিভ্রান্তি আরও বাড়তে পারে। যা উদ্বেগের বিষয় হবে। আমরা জানি যে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ভ্যাকসিন ইস্যুটি পলিটিসাইজড করা হয়েছে। আমি ভারতের টেলিভিশনে দেখলাম যে, তাদের নিজস্ব যে ভ্যাকসিনটি (কোভ্যাক্সিন), সেটার মানসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়েও অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে যেসব বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, আমার মনে হয়, দুই সরকারের পক্ষ থেকেই বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত। অন্যথায় ভ্যাকসিন নিয়ে জনমনে অনাস্থা তৈরি হতে পারে। আমি মনে করি, ভ্যাকসিনের মান, ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মনে বিশ্বাস রাখা খুব জরুরি।’
চুক্তির বিষয়টি পরিষ্কার করা নিয়ে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এজন্যই আমি বলছি যে, সরকারকে জনসম্মুখে এটা নিয়ে কথা বলছে হবে। এতে জনগণের মনে কোনো বিভ্রান্তি থাকবে না, তাদের মনে আস্থা তৈরি হবে এবং তারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা ধরে রাখাটা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, ভ্যাকসিন নিয়ে ইতোমধ্যেই বিশ্বে অনেক ধরনের পলিটিসাইজেশন হয়ে আছে। ভ্যাকসিন ইস্যু নিয়ে যাতে কোনো ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি না হয়, এর জন্য সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।’
অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘প্রথমত, ভারত সরকারের অভ্যন্তরীণ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে হওয়া ভারত সরকারের চুক্তি অনুযায়ী, সেরাম ইনস্টিটিউট যে ভ্যাকসিন তৈরি করবে, সবই সরকারকে দিতে হবে। এবং সরকারই তা বিতরণ করবেন। সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে যে, তারা সীমিত পরিমাণে হলেও রপ্তানি করবে কি না, নাকি আগে নিজ দেশেই সরবরাহ করবে। দ্বিতীয়ত, আমরা দেখেছি, চুক্তিটা সই হয়েছে সেরাম, বেক্সিমকো ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে। বেক্সিমকো আমাদের এখানে সেরামের প্রতিনিধি। তারা সেরামের কাছ থেকে কিনে বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিক্রি করবে। এই যে প্রক্রিয়া, এই চুক্তিকে জিটুজি বলার কোনো সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। আমরা খবরে দেখেছি যে, সেরামের কাছ থেকে ভারত সরকার অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি কিনবে দুই-আড়াই ডলারে। আর বাংলাদেশ সরকার বেক্সিমকোর কাছ থেকে কিনছে পাঁচ ডলারে। জিটুজি হলে তো আর এরকম হতো না। জিটুজি হলে ওই একই দামে পাওয়ার কথা বাংলাদেশ সরকারের। শুধু ট্যাক্স বা ভ্যাট যা আছে, সেগুলো যোগ হতো। সার্বিক প্রক্রিয়া দেখে বোঝা যায় যে, এটাকে জিটুজি বলার কোনো সুযোগ নেই।’
ভ্যাকসিন নিয়ে চলমান বিভ্রান্তি নিরসনে বাংলাদেশ সরকার বা গণমাধ্যম সরাসরি ভারত সরকার বা সেরামের কোনো ঊর্ধ্বতন কারো বরাত দিতে পারেনি। এ বিষয়ে এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এখানেই তো প্রশ্নটা, এখানে যদি বাধা না থাকত, তাহলে অফিশিয়ালি স্টেটমেন্ট আসবে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে যে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বিধি-নিষেধ কার্যকর নয়। কিন্তু, এরকম কিছু আসেনি। সেরামের সঙ্গে ভারত সরকারে চুক্তি অনুযায়ী, তারা যা তৈরি করবে, সবটাই সরকারকে দিয়ে দিতে হবে। তাহলে সেরামেরও তো সরাসরি বাংলাদেশে বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই।’
এই যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটা হলো, সেটাতো কেউ দেখেনি বা পড়ে শোনানো হয়নি কিংবা এটা প্রকাশিত না বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যতটুকু জানি, চুক্তি অনুযায়ী ৫০ লাখ ডোজ করে করে এক মাস পর পর ছয় মাসে তারা আমাদেরকে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেবে। সেই চুক্তিতে নিশ্চয়ই মূল্য নির্ধারণ, ট্রান্সপোর্টেশন-ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে, কে বা কারা করবে— এসব ছিল। এসব তো আমাদেরকে বা মিডিয়ায় জানানো হয়নি। তো এই যে বলা হচ্ছে, চুক্তি অনুযায়ী আমরা ভ্যাকসিন পাব, এগুলো তো “ভেক” কথাবার্তা। সেই চুক্তিটা কী? চলমান জরুরি পরিস্থিতিতে চুক্তির আলোকে বিষয়টি জনসম্মুখে পরিষ্কার করে বলা উচিত ছিল। চুক্তি তো জনগণের জন্য। এটা তো কোনো গোপন চুক্তি না। গোপন চুক্তি হলে ধরে নিতে হবে এখানে “লুকোচুরি”র কিছু আছে।’
‘এখন কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন যে, “ভারত সরকার দুই-আড়াই ডলারে পায়, তাহলে আমরা কেন পাঁচ ডলারে কিনব? এখানে বেক্সিমকোকে বাণিজ্যের সুযোগ দেওয়া হয়েছে কি না?” এই যে বিষয়গুলো মানুষের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে, এগুলো তো পরিষ্কার করতে হবে। সরকারের যে স্বচ্ছতা, সেটা মানুষের মাঝে প্রমাণিত হতো চুক্তির বিষয়ে সবাই জানলে। কিন্তু, এগুলো গোপন রাখার কারণে সরকার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু, এটার তো কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা অন্য কারো স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তো সরকার না। এই যে ভ্যাকসিন নিয়ে ধোঁয়াশা, মানুষের মাঝে সন্দেহ-উদ্বেগ, মিডিয়া ও বিশেষজ্ঞদের ওপর দোষ দেওয়া হচ্ছে যে, তারা সমালোচনা করছে। এখন এই সুযোগটাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন তৈরি করে দিয়েছে? তারা কেন পরিষ্কারভাবে সব তুলে ধরছে না? মানুষ সব জানলে তো তাদের মাঝে আর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ত না। পরোক্ষভাবে এই সুযোগটা তো তৈরিই করে দেওয়া হচ্ছে। এখন যদি তারা বিষয়টি পরিষ্কার না করে, তাহলে প্রমাণিত হবে যে, বিষয়টি আসলেই নেতিবাচক’, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান।
আরও পড়ুন:
ভারত থেকে ভ্যাকসিন আমদানি ও জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন
ভারতের ভ্যাকসিন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হবে না: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
যতদূর জানি ভারতের নিষেধাজ্ঞা আমাদের চুক্তিকে ব্যাঘাত করবে না: স্বাস্থ্যসচিব
আশ্বস্ত থাকতে পারি, আমরা চুক্তি অনুযায়ী ভ্যাকসিন পাব: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
বাংলাদেশ যথাসময়েই ভ্যাকসিন পাবে: বেক্সিমকো
ভ্যাকসিন রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা
ভারতে কোভিশিল্ড, কোভ্যাক্সিন অনুমোদন
ভারতে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের অনুমোদন বাংলাদেশের জন্যেও সুসংবাদ
Comments