ভর্তিযুদ্ধে জন্মতারিখ বিড়ম্বনা

অবশেষে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে বিষয়টির একরকম রফা হয়েছে বলে মনে হয়। সম্প্রতি করোনা সংকটে বিপর্যস্ত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় উটকো ঝামেলা হয়ে দেখা দেয় মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভর্তির আবেদন প্রসেসিংয়ের ক্ষেত্রে জন্মতারিখ জটিলতা।
প্রতীকী ছবি

অবশেষে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে বিষয়টির একরকম রফা হয়েছে বলে মনে হয়। সম্প্রতি করোনা সংকটে বিপর্যস্ত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় উটকো ঝামেলা হয়ে দেখা দেয় মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভর্তির আবেদন প্রসেসিংয়ের ক্ষেত্রে জন্মতারিখ জটিলতা। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কর্তৃপক্ষ এবারে সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্কুলে এনে ভর্তি পরীক্ষার নেওয়ার বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় অনলাইনে আবেদন শেষে লটারির মাধ্যমে ভর্তির সিদ্ধান্ত দেয়। মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে আবেদনের জন্যে সময় ছিল ডিসেম্বরের ১৫ থেকে ২৭ তারিখ। অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের পক্ষে আবেদন করতে গিয়ে বরাবরের মতো ইন্টারনেটের ধীরগতি ও সার্ভার সমস্যা জনিত ভোগান্তির পাশাপাশি নতুন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছিল, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য অনলাইন আবেদনের ক্ষেত্রে সিস্টেমে শিশুর জন্মসনদে উল্লেখ থাকা জন্মতারিখ ইনপুট দেওয়ার পর তা ওই শ্রেণির জন্য কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত ন্যূনতম বয়সসীমার (অন্যূন ১১ বছর) সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ না হওয়ায় আবেদনগুলো প্রসেস করা যাচ্ছে না। ফলে, বহু অভিভাবক তাদের সন্তানদের জন্যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হন। এটা নিয়ে দেশময় রীতিমতো হৈচৈ পড়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে একজন অভিভাবক রিট করলে হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আদেশ স্থগিত করে এগারো বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীরাও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন করতে পারবে বলে আদেশ দেন। একই সঙ্গে, ইন্টারনেট ও সার্ভারের সমস্যা বিবেচনায় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনলাইনে ভর্তির জন্য আবেদন জমা দেওয়ার সময়সীমা সাত কার্যদিবস বাড়ানোর নির্দেশ দেন। (দ্য ডেইলি স্টার, ডিসেম্বর ২৯, ২০২০)

এ দেশে যে কোন পর্যায়ে—স্কুল-কলেজই হোক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়—ভর্তি প্রক্রিয়া মানেই এক মহারণ। শিশু কিশোরদের ক্ষেত্রে এ যুদ্ধের প্রধান অংশীজন হয়ে দাঁড়ান তাদের বাবা-মায়েরা। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তান-সন্ততিদের নামীদামী স্কুলে ভর্তি করানোর জন্যে এমন কসরতে ব্যাপৃত হন, যুদ্ধে নেমেছেন বললেও কম বলা হবে। ভর্তির মৌসুমে নামীদামী স্কুলগুলোতে যে প্রচণ্ড ভিড়-ভাট্টা জমে, সাজ-সাজ রব উঠে, তা সত্যিই দেখার মতো বৈকি। অনেক অভিভাবক এমনকি ভর্তি পরীক্ষার জন্যে শিশু-কিশোরদের প্রস্তুত করতে এক বা একাধিক গৃহশিক্ষক রাখেন কিংবা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করান। অন্যদিকে, স্কুল কর্তৃপক্ষকেও ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির এ বিপুল কর্মযজ্ঞের আয়োজনের ঝক্কি-ঝামেলা তো নিতেই হয়, অনেক সময় নিয়মের বাইরে গিয়ে ছেলে-মেয়ে ভর্তির জন্য বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের তদবিরের চাপও সইতে হয়।

হাতে গোনা কিছু নামীদামী স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করাতে অভিভাবকদের এই যে প্রাণান্ত চেষ্টা আপাতদৃষ্টিতে তার একটি কারণ, এসব স্কুলের সঙ্গে অন্য স্কুলগুলোর মানের বিপুল ফারাক। তবে, এখানে মান বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছে তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন। একটি বিষয় তো অবশ্য আছেই। বছর শেষে যখন কেন্দ্রীয়ভাবে আয়োজিত বিভিন্ন পরীক্ষার ফল বেরোয়, দেখা যায় এসব স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বিপুল জয়জয়কার। তবে, এটা কি এ কারণে যে, এসব স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ ও পাঠদানের মান অনেক উঁচু? নাকি এর কারণ এই যে, স্কুলের নাম-ডাকের কারণে মেধাবী মুখগুলো সব ওখানেই গিয়ে জড়ো হচ্ছে? হয়তোবা দুটো বিষয়েরই ভূমিকা আছে। তবে, এসব প্রশ্ন যে কারণে উঠে তা সম্ভবত এই যে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এসব স্কুলে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের একটি বড় অংশ স্কুলের বাইরেও এক বা একাধিক প্রাইভেট টিউটরের সাহায্য নিয়ে থাকে। যদি এই ছেলে-মেয়েগুলো বিশেষ কিছু স্কুলে কেন্দ্রীভূত না হয়ে বিভিন্ন স্কুলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত, তাহলে হয়তো বছর শেষে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলের চিত্রটাও কিছুটা ভিন্ন হতো। তবে, অভিভাবকরা এসব শুনতে চাইবেন না। উনারা নামীদামী স্কুলসমূহের পেছনেই ছুটবেন। তাছাড়া, সাহচর্যেরও তো একটি আলাদা গুরুত্ব আছে। ছেলে-মেয়েরা কাদের সাথে ওঠাবসা করছে, প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, তাদের সার্বিক মানস গঠনে, অন্তর্নিহিত প্রতিভার বিকাশে এসবেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

বিগত কয়েক বছর ধরে কর্তৃপক্ষ নবম ও একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষার পরিবর্তে জেএসসি/জেডিসি ও এসএসি/দাখিল পরীক্ষার ফলাফল বিবেচনায় নিচ্ছে এবং পাশাপাশি অনলাইনে আবেদনের প্রক্রিয়া চালু করেছে। এর ফলে অভিভাবকদের এসব অহেতুক দৌড়-ঝাঁপের পারদ অনেকটাই নেমে আসে। অনলাইন সিস্টেম চালু করতে গিয়ে অবশ্য প্রথম প্রথম কিছু সমস্যা হচ্ছিল। যেমন, আবেদনকারীদের এই সিস্টেমে অনভিজ্ঞতা, সার্ভারের চাপ নিতে না পারা, প্রকাশিত ফলাফলে ভুল-ভ্রান্তি, ছাত্র-ছাত্রীদের অগোচরে কিছু প্রতারকের তাদের রোল নম্বর ও অন্যান্য তথ্য ব্যবহার করে আগে ভাগে আবেদন করে রাখা ইত্যাদি। তবে, সমস্যা যা হচ্ছিল তা একটি নতুন সিস্টেম প্রবর্তনের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক কিছু নয় এবং ধীরে ধীরে কেটে উঠছিল। প্রসঙ্গত, নবম ও একাদশ শ্রেণির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষার রীতি উঠিয়ে দেওয়া হলেও, সারা দেশের স্কুলগুলোয় প্রথম শ্রেণিতে লটারির মাধ্যমে এবং দ্বিতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়ে আসছিল। এবারই কেবল করোনার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হওয়ায় প্রথম থেকে নবম পর্যন্ত সব শ্রেণিতেই লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

অনলাইনে আবেদনের অন্যান্য সমস্যাগুলোর সঙ্গে সবাই আগে থেকেই একরকম পরিচিত থাকলেও জন্মতারিখ জটিলতাটা ছিল এখানে একটি নতুন সংযোজন। জন্মতারিখ ও বয়সসীমার বিধিনিষেধ যে আগে ছিল না তা কিন্তু নয়। হয়তোবা এবারে বিষয়টি যেভাবে সিরিয়াসলি মনিটর করা হচ্ছে, আগে তেমনটি হয়নি। একটি শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর ন্যূনতম বয়সসীমা বেঁধে দেয়া অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে। দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের জন্য সুনির্দিষ্ট বয়সসীমা আছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইভেন্ট ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্যে বয়সভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপ থাকে। বিদেশে বিভিন্ন স্কলারশিপ প্রাপ্তি, চাকরিতে অংশগ্রহণ এবং কোন কোন দেশে ইমিগ্রেশন লাভেও একটি সুনির্দিষ্ট বয়সসীমা বিবেচনায় নেওয়া হয়। তবে, এখানে যে বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে তা হল, একটি শিশু যদি অপেক্ষাকৃত কম বয়সে প্রথম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করার মতো উপযুক্ত হয়ে উঠে, সেক্ষেত্রে তার বয়সটা বাড়িয়ে লিখতে হলে তাকে এফিডেভিট করে তার প্রকৃত জন্মতারিখের পরিবর্তে একটি ভুয়া জন্মতারিখ গ্রহণ করতে হবে। নীতি নৈতিকতার বিচারে এটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য? আমরা কি এর মাধ্যমে তাকে তার শৈশব থেকে অনৈতিক কাজে অভ্যস্ত করে তুলছি? প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে সমাধান কোথায়? এখান থেকে বেরিয়ে আসার একটা উপায় করা অবশ্যই জরুরি। আমরা কি জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই যেন সব শিশুর জন্ম নিবন্ধিত হয় তা নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি?

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।) 

Comments

The Daily Star  | English

Police didn't follow int'l standards while using lethal weapons: IGP

Police failed to adhere to the standards in home, which they have maintained during their UN missions, Mainul Islam said

5h ago