বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারির ভাষণে দেশ পরিচালনার সবরকম দিক-নির্দেশনা ছিল: প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে স্বাধীন দেশে ফিরে রেসকোর্সের ময়দানে দেওয়া জাতির পিতার ভাষণে একটি স্বাধীন দেশ পরিচালনার সবরকম দিক-নির্দেশনা ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকায় এসেই জাতির পিতা রেসকোর্সের ময়দানে ছুটে যান। তারপর সেখানে যে ভাষণটি দেন তাতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার সবরকম দিক নির্দেশনা ছিল। অথচ হাতে কোনো কাগজ ছিল না, নিজে থেকেই বলেছেন।’
জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভার সভাপতিত্বকালে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ২৩, বঙ্গবন্ধু এভেনিউয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ভার্চুয়ালি সভায় অংশগ্রহণ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘একজন মানুষ একটি জাতির প্রতি কতোটা নিবেদিত হলে, মানুষকে কতোখানি ভালোবাসলে এমন আত্মত্যাগ করতে পারে। তা জানতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ আমাদের নতুন প্রজন্মের ৭ মার্চের ভাষণ এবং ১০ জানুয়ারির ভাষণ বারংবার শোনা উচিত। তাহলেই রাজনীতি করার একটা প্রেরণা এবং দিক নির্দেশনা সবাই পাবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে মানুষের জন্য জাতির পিতা আজীবন ত্যাগ এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছেন, তার স্বাধীন দেশে সেই জনগণের মাঝে তিনি ফিরে আসেন এবং এসেই যে মানুষকে তিনি ভালবাসতেন, রেসকোর্সের ময়দানে সেই মানুষের কাছেই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতার পাকিস্তানী কারাগারে থেকে ৪০ পাউন্ড ওজর কমে যায়। তবু মুক্তি পেয়ে তিনি সেই জীর্ণশীর্ণ দেহ নিয়েই লন্ডন চলে যান এবং প্রধানমন্ত্রী হিথের সঙ্গে বৈঠক করেন, সংবাদ সম্মেলন করেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সেখান থেকে তিনি দিল্লি হয়ে দেশে ফেরেন এবং সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তার সাক্ষাত হয় এবং সেখানেও তিনি জনগণের সামনে বক্তৃতা দেন। এরপর ঢাকায় এসেই তিনি রেসকোর্সের ময়দানে ছুটে যান।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই ভাষণে বন্ধুপ্রতীম দেশ যারা সহযোগিতা করেছে, তাদের প্রতি যেমন কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন, তেমনি দেশের মানুষের প্রতি পাকিস্তানী বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের কথাও তিনি তুলে ধরেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের একটাই চিন্তা যে, জাতির জন্য আমাদের মহান নেতা জীবন দিয়ে গেছেন, সেই জাতির কল্যাণ করা। তাদের জীবন সুন্দর করা। আর সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দেশকে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত রেখে উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব-জাতির পিতার এই প্রত্যাবর্তন দিবসে এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।’
তিনি বলেন, ‘এ জাতি বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলবে। এ জাতিকে যারা ব্যর্থ করতে চেয়েছিল, আজকে তারাই ব্যর্থ। আজকে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে স্বাধীন দেশ হিসেবে যে মর্যাদা পেয়েছে, তা ধরে রেখে আমরা বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাব।’
বাঙালির চিরায়ত ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘এ দেশের ভূমিপুত্র হিসেবে একমাত্র জাতির পিতাই প্রথম দেশের শাসনভার হাতে নিয়েছিলেন। তার আগে যারাই ক্ষমতায় ছিলেন, তাদের কারও জন্ম এ দেশে ছিল না।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা শাসন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে একে গণমুখী করার জন্যই দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। সেটা যদি করে যেতে পারতেন তাহলে মাত্র ৫ বছরেই বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠতে পারতো। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, আজকে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে দেখি সমস্ত কাজের ভিত্তিটাই তিনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন।’
মাত্র সাড়ে ৩ বছরের শাসনামলে জাতির পিতা এতো আইন, এতো নীতিমালা কীভাবে করে যান সেটা একটা বিস্ময় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রারম্ভিক বক্তৃতা করেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, রমেশ চন্দ্র সেন এবং আব্দুল মতিন খসরু, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল এবং এস এম কামাল হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এবং ডা. রোকেয়া সুলতানা বক্তৃতা করেন।
এ ছাড়া, অন্যান্যের মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর এবং দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও আবু আহমেদ মান্নাফি এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কোচি ও হুমায়ুন কবির বক্তৃতা করেন।
দলের প্রচার সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ গণভবন থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ কোনোদিন আত্মনির্ভর হয়ে মাথা তুলে নিজের পায়ে দাঁড়াক সেটা স্বাধীনতা বিরোধীরা কোনদিন চায়নি বলে জাতির পিতাকে শুধু হত্যাই করেনি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সকল আদর্শকে বিচ্যুত করেছিল।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা দেশের সঠিক ইতিহাস জানতে দেয়নি, বিজয়ী জাতি হিসেবে আমাদের যে গর্ব করার মত অনেক কিছু রয়েছে। সে কথাটা অনেকেই জানতেই পারেনি। ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরেই সকলে ইতিহাসটা আস্তে আস্তে জানতে পারে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের যে নতুন প্রজন্ম তাদের আগ্রহ জন্মেছে দেশের ইতিহাস জানার বিষয়ে সেটাই সব থেকে আশার বিষয়।’
তিনি বলেন, ‘আজকের এই করোনাভাইরাস আমাদের অগ্রযাত্রাকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মুজিববর্ষ উদযাপন করছি এবং আর কিছুদিন পর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা উদযাপন করব। জাতির পিতা ২৬ মার্চ স্বাধীনতার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই ৫০ বছর পূর্তিই আমরা উদযাপন করব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনাভাইরাসের জন্য যেভাবে কাজ করার কথা সেভাবে করতে পারছি না। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যে জাতির জন্য জাতির পিতা এতো ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন, সেই দেশের সকল মানুষের একটা ঠিকানা, অর্থাৎ গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষকে আমরা ঘর করে দেব।’
প্রধানমন্ত্রী এসময় মুজিববর্ষ হিসেবে তার সরকারের গৃহীত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, যুব মহিলা লীগসহ আমাদের যতো সংগঠন রয়েছে প্রত্যেককে আমি অনুরোধ করব, আপনারা বাড়ির পাশের গৃহহীন, ভূমিহীন নিঃস্ব মানুষটির কথা জানাবেন। আমরা তাদের ঘর করে দেব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জাতির পিতার সংগঠন। জনগণের সেবা করার জন্যই এই সংগঠন সৃষ্টি। এই সরকারও জনগণের সেবক। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী হয়তো আমরা ঘটা করে উদযাপন করতে পারিনি। কিন্তু, আমরা দেশের মানুষের সেবা করেই সেটা উদযাপন করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘খুব শিগগিরই ৪৬ হাজার মানুষকে আমরা ঘর দেব এবং ৭৬ হাজার মানুষের ঘর তৈরি হচ্ছে। কত লোক গৃহহীন রয়েছে তাদের তালিকা করে আমরা ঘর করে দিতে চাই।’
প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। প্রতিটি ঘর আমরা আলোকিত করব। চিকিৎসা সেবাকেও আমরা মানুষের দোরগোড়ায় দিয়েছি।’
তিনি এসময় করোনা ভ্যাকসিন দেশে আনার বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান পুণর্ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনাভাইরাসের জন্য ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন ক্রয় করার সমস্ত ব্যবস্থা আমরা করেছি। ইনশাল্লাহ এসে যাবে। তারপরেও বলব সবাইকে স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে নিজেকে এবং অন্যকেও রক্ষা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যতোই ভ্যাকসিন আনি না কেন, মাস্ক পড়া, হাত ধোয়া, রোদে থাকা, ভিটামিন ডি এবং সির ঘাটতি পূরণ করা প্রভৃতি বিষয়গুলো কিন্তু মেনে চলতে হবে। আর এটা মেনেই আমরা করোনাভাইাসকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি।
তিনি গত বছরের মার্চ মাসে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আবারও হয়তো সেই সময় একটা ধাক্কা দিতে পারে।’
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের এই দিনে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। আর এর মাধ্যমেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় পূর্ণতা লাভ করে।
Comments