দায় মেয়েটিরই!

বাংলাদেশে নারী ধর্ষণ
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

দু’একটি ঘটনা শরীর ও মনের ওপর এতটাই প্রভাব ফেলে যে, স্বাভাবিক চিন্তার গতি যেন থমকে যায়। কলাবাগানে ‘ও’ লেভেল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ-হত্যা তেমনই একটি ঘটনা। এখানেই শেষ নয়। ঘটনা-পরবর্তী ঘটনা আরও হৃদয়বিদারক, আরও মর্মান্তিক।

শুরুতেই বাংলাদেশের মানুষের একটি অংশ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে যে, দায় শিক্ষার্থী মেয়েটির। দায় মেয়েটির পরিবারের।

সে কেন তার বন্ধুর বাড়িতে গেল? তার মা কেন তাকে যেতে দিলেন? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমন প্রশ্নে সয়লাব। কোনো সংশয় বা সন্দেহ না রেখে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছে যে, দায় মেয়েটির। কেন এমন পোশাক পরল, এমন সময় কেন বাইরে গেল, সম্পর্ক ছিল, ইত্যাদি বলে দায় চাপানো হয় সেই মেয়েটির ওপর, যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। যাকে হত্যা করা হয়েছে বা যার পরিপ্রেক্ষিতে নিহত বা আহত হয়েছে।

নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত— সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, এ সমাজ নিপীড়িত নারীর ওপরই দায় চাপাতে অভ্যস্ত। এই দায় চাপানোর যে মানসিকতা তা কি বহু আগে থেকেই ছিল, না নতুন করে তৈরি হয়েছে? হয়তো আগে থেকেই ছিল, সামাজিক মাধ্যম না থাকায় প্রকাশ কম ছিল। বর্তমানে সামাজিক মাধ্যমের ফলশ্রুতিতে মানসিকতার এই ধরন দৃশ্যমান হয়েছে। দৃশ্যমানের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে এমন মানসিকতার সংখ্যাও বেড়েছে।

এমন মানসিকতা গড়ে ওঠার পেছনে কয়েকটি বিষয় বেশ বড়ভাবে ভূমিকা রাখে। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বা দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন এমন মানসিকতা পোষণ করে, তা সাধারণজনকে সংক্রমিত করে।

সংসদ সদস্যদের কেউ যখন সংসদে দাঁড়িয়ে ‘ধর্ষণের জন্যে মেয়ের পোশাক দায়ী’, ‘স্বাধীনভাবে চলাচল দায়ী’ নিপীড়িত নারীকে দোষী করে এমন বক্তব্য রাখেন, তার প্রতিবাদ সেইভাবে দৃশ্যমান হয় না। সংসদের ভেতরে না, বাইরেও না। সমাজে এর কী প্রভাব পড়ে, সেটা একটা প্রশ্ন। তারচেয়েও বড় প্রশ্ন, এর মধ্য দিয়ে সমাজের চরিত্র বোঝা যায়।

এসব ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা বহু বছর ধরে আলোচনায় আছে। ঘটনার শুরুতেই পুলিশ বেশ কৌশলের সঙ্গে কিছু বিষয় জনমানুষের ভেতরে ছড়িয়ে দেয়। ধর্ষণ বা নিপীড়নে শারীরিক-মানসিকভাবে আহত বা নিহত নারীকে নিয়ে কিছু কথা বলে। সেই কথাগুলো সারাদেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। কলাবাগানের এই মেয়েটি হত্যার পরেও পুলিশের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। সেই বক্তব্য হুবহু উদ্ধৃত করছি না। পুলিশের বক্তব্যের মর্মার্থ এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করার একটা চেষ্টা যে, মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়নি। যা কিছু হয়েছে, ‘পারস্পরিক সম্মতিতে’ হয়েছে। ‘জোর-জবরদস্তি’ করা হয়নি, তা পুলিশ খুব সহজে নিশ্চিত হয়ে গেছে। যা মোটেই সহজ বিষয় নয়। এত দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো বা বলারও বিষয় নয়। ‘দুই মাস ধরে’ প্রেমের সম্পর্ক ছিল, এ কথা পুলিশের কর্মকর্তারা তদন্তের শুরুতেই গণমাধ্যমে বলাটা অপরিহার্য মনে করেছে।

হত্যায় অভিযুক্ত দিহান রক্তাক্ত মেয়েটিকে হাসপাতালে এনে বয়স বলেছিল ১৯ বছর। প্রকৃতপক্ষে ‘ও’ লেভেল শিক্ষার্থী মেয়েটির বয়স ১৭ বছর ৩ মাস। মেয়েটি যখন মারা গেছে বা যাচ্ছিল, তখনো দিহানের মাথায় কাজ করেছে যে, বয়স ১৮ বছরের বেশি দেখাতে হবে। সে বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ১৯ বছর বলেছে। পুলিশ তা অনুসরণ করে মামলার কাগজে বয়স ১৯ বছর লিখেছে। মেয়েটির মা সনদ দেখিয়ে পুলিশকে বলেছে তার মেয়ের বয়স ১৭ বছর। কিন্তু, পুলিশ সনদ দেখিয়ে কথা বলা মায়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছে দিহানকে। পুলিশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেছেন মেয়েটির মা। পুলিশ যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছে, হাসপাতালে ভর্তির সময় বয়স লেখা হয়েছিল ১৯ বছর। পুলিশের এই তথ্য অজানা ছিল না যে, হাসপাতালকে এই বয়স বলেছিল দিহান। পুলিশের কৃতকর্ম বিশ্লেষণ করলে দুটি বিষয় পরিষ্কার হয়। প্রথমত, পুলিশ ‘পারস্পরিক সম্মতি’র বিষয়টিকে সামনে আনতে চেয়েছে। দ্বিতীয়ত, মেয়েটির বয়স ১৮ বছরের বেশি, মানে তিনি প্রাপ্ত বয়স্ক। এই দুটি বিষয় প্রমাণ করা গেলে দিহানের দায় অনেকটাই কম দেখানো যায়। পুলিশের এই আচরণের কারণ কী?

পুলিশের কাছে মায়ের চেয়ে, বয়স নিশ্চিতের সনদের চেয়ে, দিহানের দেওয়া তথ্য কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল? এর নানা সমীকরণ নিয়ে আলোচনা করা যায়। আলোচনা না করলেও, ধারণা করি বুঝতে কারোরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। মূলধারার অধিকাংশ গণমাধ্যম মেয়েটির নাম, ছবি প্রকাশ করেনি। কিন্তু, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো বটেই, অনেক গণমাধ্যমকেও মেয়েটির পরিচয় প্রকাশ করতে দেখা গেছে। পুলিশের ভাষ্য হুবহু প্রচার-প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এখানে সংবাদকর্মীদের যে সংবেদনশীলতা দেখানো প্রত্যাশিত ছিল, তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয়নি। সব গণমাধ্যম এমন করেনি, কেউ কেউ করায় দায় কমবেশি সবাইকেই নিতে হচ্ছে।

যেখানে পুলিশের কাছে প্রশ্ন করা দরকার যে, কেন আপনারা ভুক্তভোগীর ওপর দায় চাপিয়ে কথা বলছেন? তা না করে, হুবহু পুলিশের বক্তব্য প্রকাশ করে নিহতের পুরো পরিবারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েটি নিহত হয়েছে, তার বক্তব্য জানার কোনো সুযোগ নেই। ‘পারস্পরিক সম্মতি’র বিষয়টি সামনে এনে যে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা চলছে, প্রায় সবক্ষেত্রে চলে, তা দিয়ে আসলে অপরাধকে কিছুটা হলেও জাস্টিফাই করার চেষ্টা হয়। যেন মেয়েটি তাকে হত্যার ‘সম্মতি’ দিয়েছে!

প্রকৃত সত্য বা কাছাকাছি সত্য জানা যাবে যদি সুষ্ঠু তদন্ত হয়। আর এই তদন্ত করবে পুলিশ। তদন্তের আগেই পুলিশের বক্তব্যে যদি পক্ষ নেওয়া দৃশ্যমান বা অনুমিত হয়, তাহলে আস্থা বা বিশ্বাস বলে কিছু থাকে না। এবং এটাই যেন বাংলাদেশের মানুষের নিয়তি হয়ে গেছে।

আমাদের সমাজে আরও একটি বিষয় প্রকটভাবে দৃশ্যমান, তা হলো শ্রেণিগত অবস্থান। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভেতরে চরম বিদ্বেষমূলক মানসিকতা বিরাজমান। ধরেই নেওয়া হয়, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে যারা পড়ালেখা করে তারা সবাই উচ্চবিত্ত শ্রেণির। তারা বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন। তাদের আচার-আচরণ, জীবনযাপন পশ্চিমা ধরনের। ‘পশ্চিমা ধরন’ বলতে কী বোঝায় বা সেটা কেমন, সে সম্পর্কে যা জানে তা আবার বিভ্রান্তিকর।

বর্তমানে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু উচ্চবিত্তের সন্তানরাই পড়ালেখা করেন না, মধ্যবিত্তের সন্তানরাও পড়ালেখা করেন। সরকারি ও বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোর ক্রমাবনতির প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত বাধ্য হয়ে ইংরেজি মাধ্যমের প্রতি ঝুঁকছে। একই কথা প্রযোজ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সমাজ-দেশ বিচ্ছিন্ন নয়, তার জীবন্ত উদাহরণ গণজাগরণ মঞ্চ ও ভ্যাট-বিরোধী আন্দোলন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিল। আর ভ্যাট-বিরোধী অভিনব সফল আন্দোলনের পুরোটাই করেছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সুতরাং তাদেরকে দেশ-সমাজ বিচ্ছিন্ন ট্যাগ দিয়ে বিদ্বেষমূলক মানসিকতা পোষণ করা মোটেই যৌক্তিক নয়।

অভিযুক্ত ধর্ষক-হত্যাকারী দিহানের বাবা একজন সাধারণ সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে অবসর নিয়েছেন। গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করছে, তিনি বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক। একজন সাব-রেজিস্ট্রার কত বেতন পান আর মাসে কত আয় করেন, তা অজানা কিছু নয়। সবার ক্ষেত্রে না হলেও, অধিকাংশই ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর এ কথা শুধু সাব-রেজিস্ট্রারের ক্ষেত্রে নয়, সরকারি কর্মজীবী বড় কর্তাদের ক্ষেত্রে যে প্রযোজ্য নয়, তা তো বলা যাবে না। সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, টাকা পাচার করে কানাডার বেগম পাড়ায় যারা বড় বড় বাড়ি কিনেছেন, তাদের মধ্যে বর্তমান ও সাবেক আমলার সংখ্যাই বেশি। সুতরাং এই অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতি এখন একটি সিস্টেমের নাম। দীর্ঘ বছরের সুশাসনহীনতায় এই সিস্টেম প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়ে গেছে।

তার প্রভাব নানাভাবে সমাজের ওপর পড়ছে। অভিভাবক ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থে যখন স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া সন্তানকে গাড়ি কিনে দেন, হিসাব ছাড়া খরচের সুযোগ করে দেন, তার নেতিবাচক প্রভাব অস্বাভাবিক কিছু নয়। তখন একজন ঐশী মাদকে আসক্ত হয়ে বাবা-মাকে হত্যা করতে পারে। একজন দিহান পয়সা দিয়ে জীবন উপভোগের নীতিতে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। ধর্ষণ-হত্যা কোনো কিছু নিয়েই সে ভীত থাকে না। সে ধরে নেয় অসৎ বাবা-মা অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ দিয়ে তাকে রক্ষা করবে। এক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যমের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা একটা সমাজের চরিত্র হয়ে গেছে।

দেশের বয়স বাড়ছে। সমাজের রূপান্তর ঘটছে। সমগ্র পৃথিবী একটি মোবাইল ফোনে। অভিভাবকদের আরও সচেতনতা নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে। কোন বয়সের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। হওয়া প্রয়োজনও। কিন্তু, সবচেয়ে জরুরি সমাজ-রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মানসিকতার পরিবর্তন। ভুক্তভোগীর ওপর দায় চাপানো মানে অপরাধীর পক্ষ নেওয়া। এই অন্যায্য মানসিকতা-দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ধর্ষণ-অন্যায়-অনাচার বন্ধ তো হবেই না, কমানোও যাবে না।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
NCP will not accept delay in Teesta master plan

Won’t accept any implementation delay: Nahid

National Citizen Party Convener Nahid Islam yesterday said his party would not accept any delay or political maneuver over implementing the Teesta master plan.

4h ago