প্রবাসে

ব্রেক্সিট: কোন পথে ইংল্যান্ডের ভবিষ্যত

৩০ ডিসেম্বর সকাল। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম বিরিয়ানি খাব। ঘুম থেকে উঠেই দেখি বাইরে তুমুল বরফ পরা শুরু হয়েছে। আমি ইউকে তে এক বাংলাদেশি ভাইয়ের সাথে থাকি। তার নাম তানভীর আহমেদ। তানভীর ভাই এখানে বার-এট-ল করছেন। তো বরফ পড়া দেখেই তানভীর ভাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম, বললাম ভাই আজকে যেহেতু বরফ পড়ছে, সুতরাং আমাদের বিরিয়ানি কর্মসূচি বাস্তবায়িত করার আজকেই সুযোগ। ভাইও রাজি হয়ে গেলেন।
বার্মিংহ্যাম সিটি সেন্টার। ছবি: লেখক

৩০ ডিসেম্বর সকাল। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম বিরিয়ানি খাব। ঘুম থেকে উঠেই দেখি বাইরে তুমুল বরফ পরা শুরু হয়েছে। আমি ইউকে তে এক বাংলাদেশি ভাইয়ের সাথে থাকি। তার নাম তানভীর আহমেদ। তানভীর ভাই এখানে বার-এট-ল করছেন। তো বরফ পড়া দেখেই তানভীর ভাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম, বললাম ভাই আজকে যেহেতু বরফ পড়ছে, সুতরাং আমাদের বিরিয়ানি কর্মসূচি বাস্তবায়িত করার আজকেই সুযোগ। ভাইও রাজি হয়ে গেলেন।

চলে গেলাম সুপার শপে। গরুর মাংস কিনলাম এক কেজি। দাম জিজ্ঞাসা করতেই যে দাম বলল সেটা সাধারণ দামের তুলনায় এক পাউন্ডের মতো বেশি। জানতে চাইলাম, দাম কেন বাড়িয়েছেন? সোজাসাপ্টা বলে দিলেন, ব্রেক্সিটের কারণে এখন সাপ্লাই বেশি নেই।

আমি ধরেই নিয়েছি এটা ইংল্যান্ডের অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধিতে বড় আঘাত। ব্রেক্সিটের কারণে নিত্যপণ্যের দাম এখানে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। তাই এটা নিশ্চিত করেই বলা যাচ্ছে ইংল্যান্ডের অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধিতে ব্রেক্সিটের বড় একটা প্রভাব থাকবে।

এখানে পরিচিত এক স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ভদ্রলোক বার্মিংহ্যাম শহরে এক কম্যুনিটি কলেজে শিক্ষকতা করাতেন। কলেজের ফান্ডিং করতো ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ব্রেক্সিট ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার কলেজে ফান্ডিং বন্ধ করে দিয়েছে। গত মাস থেকে তার চাকরি নেই। আমি তাকে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। উনি হতাশার সঙ্গে উত্তর দিলেন, জানেন না। কিন্তু তিনি এটা বিশ্বাস করেন ব্রেক্সিট হয়ে যাওয়াতে সামনের দিনে তার ও তার সহকর্মীদের চাকরি পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।

ব্রেক্সিট ব্রিটেনের ভবিষ্যত তরুণ প্রজন্মকে চাকরির বাজারে সমস্যার সৃষ্টি করবে বলে বোঝা‌ই যাচ্ছে। একটা উদাহরণ দিই তাহলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে জার্মানিতে ৩০ লাখ দক্ষ শ্রমিক ও কর্মীর ঘাটতি হবে। ব্রেক্সিটের পর এই কাজগুলো আর যুক্তরাজ্যের ভবিষ্যত তরুণ প্রজন্মের কাছে এতটা সহজলভ্য হবে না। শুধু তাই নয়, যুক্তরাজ্যের তরুণ প্রজন্ম আগে ইচ্ছা করলেই ইউরোপের যে কোন দেশে সহজেই চাকরি নিয়ে তাদের বেকারত্ব দূর করতে পারত। এছাড়া যুক্তরাজ্যের কর্মীদের একটা ভাল চাহিদা সারা ইউরোপ জুড়েই ছিল। ব্রেক্সিট হয়ে যাওয়ার কারণে সেই সুযোগ আর থাকছে না।

এতদিন লন্ডনকে আমরা কসমোপলিটন শহর হিসেবেই জেনে এসেছি। পৃথিবীর মোটামুটি সব বড় বড় কোম্পানিগুলোর একটা করে অফিস লন্ডন থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করত। কিন্তু ব্রেক্সিট ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক কেন্দ্র নামে পরিচিত লন্ডন শহরের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিয়েছে। এরই মধ্যে লন্ডনের ব্যবসায়িক বিনিয়োগ ১১ শতাংশের মতো কমিয়ে ফেলেছে।

একটা সময় আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো লন্ডনকে ইইউ অর্থনীতিতে বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করত। গোল্ডম্যান স্যাক্স, জেপি মর্গান এবং মর্গান স্ট্যানলি ইতোমধ্যে তাদের ১০ শতাংশ ক্লায়েন্টের পরিবর্তন করেছে। ব্যাংক অফ আমেরিকা ১০০ জন ব্যাংকারকে তাদের ডাবলিন অফিসে এবং ৪০০ জন কর্মকর্তাকে প্যারিসে স্থানান্তর করেছে। এটা তো কেবল শুরু, এটা নিশ্চিত করেই বলা যাচ্ছে অন্যান্য কোম্পানিগুলোও কিছুদিন পরে এই একই পথে হাঁটা শুরু করবে, কারণ লন্ডন থেকে পরিচালিত অধিকাংশ কোম্পানির প্রধান বাজার হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সুতরাং তারা তাদের ব্যবসা এমন কোন শহরে স্থানান্তরিত করবে যেখান থেকে সহজেই ইউরোপের বাজারে ব্যবসা করা যায়। লন্ডনকেন্দ্রিক থাকলে তাদের এই সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাবে।

ব্রেক্সিটের কারণে যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একটা সম্ভাবনাময় ক্ষতি ও হুমকির দিকেই এগুচ্ছে বলে মনে করছি। এর আরও একটা কারণ আছে। কারণটা হলো, ব্রেক্সিট নিয়ে অনিশ্চয়তা চলছে সেই ২০১৫ সাল থেকে। যার ফলে ইউকে অফিস ফর ন্যাশন্যাল স্ট্যাটিস্টিক্স এর ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৫ শতাংশে এ নেমে এসেছে।  যুক্তরাজ্য সরকার আরও অনুমান করেছে যে ব্রেক্সিটের ফলে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে যুক্তরাজ্যের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। আরও একটা নেতিবাচক প্রভাবের কথা বললে আপনাদের কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। বোর্ড অফ গভনর্স অফ দ্য ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের তথ্য অনুযায়ী, এই ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের দিন ব্রিটিশ পাউন্ড ১ দশমিক ৪৮ ডলার থেকে পরের দিন ১ দশমিক ৬ ডলারে নেমে আসে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহ এবং খরার প্রবণতার কারণে গত দুই দশক ধরে যুক্তরাজ্যের  স্থানীয় খাদ্য উৎপাদন কমে গিয়েছে। এছাড়া ব্রেক্সিটের আগে যুক্তরাজ্যের কৃষি সেক্টরে কাজ করার জন্য রোমানিয়া ও অন্য ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ শ্রমিক কাজ করতে আসতো এবং ব্রেক্সিট চুক্তির আগে যুক্তরাজ্য ইইউ-এর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারত। ইইউ পরিবেশ সুরক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং শক্তিতে তাদের সদস্যদের এই প্রযুক্তিগুলো সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু ব্রেক্সিট হয়ে যাওয়ার কারণে যুক্তরাজ্য এখন থেকে এই সুবিধাগুলো আর পাবে না। যার ফলে কৃষি সেক্টরে কর্মী সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।

অন্যদিকে স্কটল্যান্ড ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। স্কটিশ সরকার সব সময়ই বিশ্বাস করে যে ইইউতে থাকা স্কটল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যের জন্য সবচেয়ে ভালো। কিন্তু যুক্তরাজ্য সরকার তাদের সেই ভালো দিকটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাজ্য সরকারকে দ্বিতীয় গণভোটের অনুমতি দিতে চাপ দেয়ার ব্যাপারে এখন স্কটল্যান্ড একটা যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেল। যুক্তরাজ্য ত্যাগ করতে, স্কটল্যান্ডকে স্বাধীনতার উপর একটি গণভোট ডাকতে হবে। এরপর স্কটল্যান্ড নিজে নিজেই ইইউ সদস্যপদের জন্য আবেদন করতে পারবে। আমার যেটা মনে হচ্ছে, স্কটল্যাণ্ডের ভবিষ্যত পরিকল্পনা সে রকমই।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ব্রেক্সিট ভোট ইউরোপজুড়ে অভিবাসন বিরোধী দলগুলোকে শক্তিশালী করছে এবং ভবিষ্যতে আরও করবে। যদি এই দলগুলো ফ্রান্স এবং জার্মানিতে যথেষ্ট সমর্থন লাভ করে, তাহলে তাদের মধ্যেও একটা ইইউবিরোধী ভাব চলে আসা অস্বাভাবিক কিছু না। যদি ওই সব দেশ ইইউ ছেড়ে চলে যায়, তাহলে ইইউ তার সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি হারাবে এবং ভেঙ্গে পড়বে।

আলোচনা শেষ করব ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে ইউকেতে যারা পড়তে আসবেন তাদের নিয়ে কিছু কথা বলে। ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা করতে যুক্তরাজ্য সরকারের বিশাল পরিমাণ ইনভেস্টমেন্ট এর দরকার হবে। আর উদার অর্থনীতির এই যুগে যুক্তরাজ্য সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটা পণ্যে রূপান্তরিত করেছে। এই শিক্ষা সেক্টর থেকে যুক্তরাজ্য সরকার প্রচুর রাজস্ব আদায় করে। সুতরাং ভবিষ্যতে এই বাজার আন্তর্জাতিক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যুক্তরাজ্য সরকার উদার হস্তে খুলে দেবে। অনেক ভূঁইফোড় কলেজ এখানে নতুন করে স্থাপিত হবে। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে পড়তে আসতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে এই বিষয়ে একটু খেয়াল রাখা। এছাড়া বাংলাদেশে অনেক এজিন্সি আছে যারা শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্বপ্ন দেখায়। তারা বলে পার্টটাইম কাজ করে টিউশন ফি দিয়ে খুব সহজেই এখানে মানিয়ে নেয়া যায়। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, এটা পৃথিবীর বড় মিথ্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ে এবং করোনার এই মহামারি ধাক্কার পরে চাকরি বাজার কতটা স্থিতিশীল থাকবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে।

লেখক: শোয়াইব মোহাম্মদ সালমান, শেভেনিং স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ রিডিং এ পাবলিক পলিসিতে অধ্যয়নরত।

Comments

The Daily Star  | English

The morale issues of Bangladesh Police

There is no denying that for a long time, the police have been used as a tool of repression in the subcontinent

2h ago