নদীর ইজারা পেলেন না জেলেরা

লালচাঁদ দাস (৬০) এখন জাল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। মাঠে বসে শুধু জাল সেলাই করেন আর শুকাতে দেন। কিন্তু, মাছ ধরতে যান না। লালচাঁদের মতো একই করুণদশায় পড়েছেন কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় চাকিরপশার নদী ওপর নির্ভরশীল চান্দামারী দাসপাড়ার মৎস্যজীবীরা।
Chakirpashar River
কুড়িগ্রামে চাকিরপশার নদীতে ইজারাদারের টহলচৌকি। ছবি: স্টার

লালচাঁদ দাস (৬০) এখন জাল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। মাঠে বসে শুধু জাল সেলাই করেন আর শুকাতে দেন। কিন্তু, মাছ ধরতে যান না। লালচাঁদের মতো একই করুণদশায় পড়েছেন কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় চাকিরপশার নদী ওপর নির্ভরশীল চান্দামারী দাসপাড়ার মৎস্যজীবীরা।

পাড়ার ৪২০ মৎস্যজীবী পরিবারের প্রায় দুই হাজার মানুষ চাকিরপশার নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু, এ বছর নদীটি ইজারা দেওয়া হয়েছে এক অমৎস্যজীবীর কাছে। তাই প্রকৃত মৎস্যজীবীদের নামতে দেওয়া হচ্ছে না নদীতে।

এর ফলে চাকিরপশার নদীর আশপাশের অন্তত ১০ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ সংকটে পড়েছেন। তারা সবাই এ নদীতে মাছ ধরে পরিবারের প্রয়োজন মেটাতেন।

ইজারা নিয়ে সেই ব্যক্তি ও তার লোকজন পাহারা বসিয়েছেন চাকিরপশার নদীতে। সেখানে তৈরি করেছেন টহল চৌকি। কয়েকটি নৌকা দিয়ে টহল দেওয়া হয় দিনে-রাতে।

লালচাঁদ দাস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘আমার সারা জীবন কেটেছে চাকিরপশার নদীতে মাছ ধরে। এ নদী থেকেই বছরের জীবিকা জোগাড় করেছি। কিন্তু, এ বছর এ নদীতে আর নামতে পারছি না।’

চাকিরপশার নদীতে মাছ ধরার সুযোগ না পেলে জাল বিক্রি করে তাকে দিনমজুরির কাজে যোগ দিবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

চান্দামারী দাসপাড়ার তারা বালা দাস (৬৫) ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই চাকিরপশার নদীতে মাছ ধরে আসছি। এ নদীতে মাছ ধরে তা বিক্রি করে সন্তানদের লালন-পালন করেছি। এ বছর এ নদীতে নামতে না দেওয়ায় ভীষণ বিপাকে পড়েছি।’

তিনি চাকিরপশার নদীকে উম্মুক্ত জলাশয় হিসেবে রাখার দাবি জানিয়েছেন।

কৈলাশকুটির গ্রামের হাসান আলী (৪৮) ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘এ নদীতে মাছ ধরে সংসার চালিয়ে আসছি। এ নদীর মাছ ধরে বিক্রি করে চার সন্তানকে স্কুল-কলেজে পড়িয়েছি। এ বছর নদীটি ইজারা দেওয়া হয়েছে এক অমৎস্যজীবীকে।’

সংসার চালাতে এখন রিকশা চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন হাসান আলী।

চাকিরপশার মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি যোগেন চন্দ্র দাস ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘নদীটি ১৯৯৬ সাল থেকে ইজারা দিয়ে আসছে প্রশাসন। স্থানীয় মৎস্যজীবীরা ইজারা নিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। তারা নদীটি ইজারা নিলেও তা উম্মুক্ত ছিল। নদীর আশপাশের লোকজনও এ নদীতে মাছ ধরতেন। কিন্তু, এ বছর এক অমৎস্যজীবী ইজারা নিয়ে পুরো নদী তাদের কর্তৃত্বে রেখেছেন।’

‘মৎস্যজীবীরা এমনকি গ্রামের লোকজনকেও এ নদীতে মাছ ধরতে দিচ্ছেন না’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছেন, ‘তারা নৌকা দিয়ে নদীতে টহল দিচ্ছেন। আমরা এখন নিরুপায় হয়ে পড়েছি। পৈত্রিক পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় যেতে হচ্ছে।’

ইতোমধ্যে অনেকেই পৈত্রিক পেশা ছেড়ে দিয়ে দিনমজুরি শুরু করেছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

রাজারহাট উপজেলা ভুমি অফিস সূত্র ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, ১৯৪০ সালের রেকর্ড অনুযায়ী চাকিরপশার নদীর মোট জায়গা ছিল ৩০৬ একর। নদীতে ভাটা পড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় দখলদাররা নদীর বিভিন্ন অংশে পাড় বেঁধে পুকুর, রাস্তা, ফসলি জমি বানিয়ে দখল করায় বর্তমানে নদীর মোট জমি রয়েছে ১৪১ দশমিক ২৯ একর।

চাকিরপশার নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ, উজানে জলাবদ্ধতা নিরসন, জেলে ও সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্তকরণ, খনন ও ইজারা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটি।

চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির সমন্বয়ক ড. তুহিন ওয়াদুদ ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘চাকিরপশার নদীর এক ইঞ্চিও কারো দখলও থাকবে না। কোনো অমৎস্যজীবী নদী লিজ নিতে পারবে না। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছে। এই নির্দেশনা না মানলে আইন লঙ্ঘন করা হবে।’

অনতিবিলম্বে এই নদীর সব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করার দাবিও জানিয়েছেন তিনি।

চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আরিফ ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘চাকিরপশার নদীতে আইন লঙ্ঘন করে অমৎস্যজীবীর কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছে। আইন অনুযায়ী বন্দোবস্তকৃত অথবা ইজারাকৃত জলমহালের কোথাও প্রবাহমান প্রাকৃতিক পানি আটকে রাখা যাবে না। কিন্তু, চাকিরপশার নদীতে এই আইন অমান্য করে উজান ও ভাটিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।’

কুড়িগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কালিপদ রায় ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘বিষয়টি শুনেছি। মৎস্যজীবীরা প্রান্তিক মানুষ। তাদের জীবিকাকে সমুন্নত রাখতে চাবিরপশার নদীটি মৎস্যজীবীর নামে ইজারা দেওয়া অথবা উম্মুক্ত করা প্রয়োজন।’

তিনি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন বলেও নিশ্চিত করেছেন।

রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুরে তাসনিম ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘সরকারি তালিকায় চাকিরপশার কোনো নদী নয়, এটি একটি বিল। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে এ বিল ইজারা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ দরদাতাকে। বিলটি ইজারা নিয়ে ইজারাদার সেখানে মাছ চাষ করছেন এবং তার মতো করে মাছ রক্ষা করছেন।’

বিলটির জমি ১৪০ জনের দখলে রয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেছেন, ‘তাদের নামের তালিকা করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের অনুমতিক্রমে যেকোনো সময় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।’

কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘চাকিরপশার বিষয়ে নদী কমিশন থেকে চিঠি পেয়েছি। এর জবাব প্রস্তুত করছি। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে জলমহালের ইজারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। মৎস্যজীবীরা যেন কর্মহীন না থাকেন সে ব্যাপারে কিছু একটা করার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

‘চাবিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির দাবির সঙ্গে আমি একমত। তবে তা বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে,’ যোগ করেন জেলা প্রশাসক।

তিনি আরও বলেছেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে চাকিরপশারে একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এবং তা শিগগির বাস্তবায়ন করা হবে।’

চাকিরপশার নদীর ইজারা গ্রহণকারী আবু বক্কর ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘আমি সরকারি নিয়ম মেনে ইজারা নিয়ে নদীতে মাছ চাষ করছি। মাছ রক্ষার জন্য টহলের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। আমি ইজারা নিয়েছি অন্যদের মাছ ধরার জন্য নয়, ইজারা নিয়েছি মাছ চাষ করে লাভবান হওয়ার জন্য।’

তিনি চার বছরের জন্য ইজারা নিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন।

Comments

The Daily Star  | English

No decision on AL independents yet: Quader

Many BNP leaders are taking part in the election because they don't want to support BNP's negative politics, says AL spokesperson

37m ago