পাখি-ঝুঁকিতে উড়োজাহাজ!

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে রাজধানীর হযরত শাহজালার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নকালে বাংলাদেশ বিমানের একজন পাইলট হঠাৎ টের পেলেন কিছু একটা তার উড়োজাহাজের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে রাজধানীর হযরত শাহজালার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নকালে বাংলাদেশ বিমানের একজন পাইলট হঠাৎ টের পেলেন কিছু একটা তার উড়োজাহাজের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে।

পাখি হতে পারে মনে করে তৎক্ষণাৎ তিনি বিমানবন্দর টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদেরকে রানওয়েতে কিছু আছে কি না, তা দেখতে বলেন।

উড়োজাহাজটির সঙ্গে ধাক্কা খাওয়া পাখিটি মরে গিয়ে রানওয়েতে পড়ে আছে, তা নিশ্চিত হয়ে কয়েক শ যাত্রীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে জরুরি অবতরণ করেন পাইলট।

সৌদি আরবগামী সেই ফ্লাইটটির পাইলট সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন, ‘পাখিটি যদি ইঞ্জিনে আঘাত করত, তাহলে উড়োজাহাজটির বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারত। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে, এটি বড় ধরনের কিছু ছিল না।’ 

বিশ্বব্যাপী বিমানবন্দরগুলোতে উড়োজাহাজে পাখির আঘাতের ঘটনাগুলো সাধারণ ঘটনা হিসেবেই বিবেচিত হয়।

এ ধরনের আঘাতের ফলে ফ্লাইট বাতিল, উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের ক্ষতি কিংবা উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। এগুলো মোকাবিলা করতে বিশ্বব্যাপী বিমানবন্দরগুলোর কর্তৃপক্ষ উড়োজাহাজ উড্ডয়ন-অবতরণের স্থান থেকে পাখিদের দূরে রাখতে আধুনিক ও প্রচলিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেরও এ ধরনের সরঞ্জাম রয়েছে। কিন্তু, সেগুলো কার্যকর নয় বললেই হয়। সেখানকার রানওয়েতে বসানো পাখি প্রতিরোধক দুইটি অটোমেটিক যন্ত্র প্রায় সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

বিমানবন্দর সূত্র বলছে, দুইটি যন্ত্রের মধ্যে একটির কাজ লেজার রশ্মির মাধ্যমে পাখিদের তাড়িয়ে দেওয়া এবং অন্যটির কাজ শব্দের মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে পাখিদের তাড়িয়ে দেওয়া।

একইসঙ্গে শব্দ করে ভয় দেখিয়ে পাখিদের দূরে সরিয়ে দিতে কিংবা প্রয়োজনে হত্যা করতে ব্যস্ততম এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থাকা ছয়টি বন্দুকের মধ্যে চারটিই গত ছয় বছর ধরে অকেজো হয়ে আছে।

বর্তমান পরিস্থিতিকে অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করে পাইলট ও অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের (সিএএবি) চরম অবহেলাকে এর জন্য দায়ী করেছেন।

বাংলাদেশ বিমানের একজন পাইলট দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সিএএবি প্রতিবছর হাজারো কোটি টাকা আয় করছে। কিন্তু, লজ্জার বিষয় এই যে, তারা পাখির আঘাত থেকে উড়োজাহজকে রক্ষা করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কয়েকটি নতুন বন্দুক কিনতে কিংবা আধুনিক প্রযুক্তির জন্য ব্যয় করতে পারছে না।’ 

‘সিএএবির এই অবহেলার জন্য অনেক চড়া মূল্য দিতে হতে পারে’, অনেকটা ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই বলছিলেন এই পাইলট।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই পাইলট জানান, ২০১৯ সালে বিমানের একটি উড়োজাহাজ অল্পের জন্য দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। কারণ, উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই পাখি আঘাত করলে তিনি অনেকটা জোর করেই উড়োজাহাজ অবতরণ করেছিলেন।

অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ঢাকার বিমানবন্দরে উড়োজাহাজে পাখিত আঘাত একটি গুরুতর বিষয়। আমরা বেশ কয়েকবার বিষয়টি সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের সামনে উত্থাপনের চেষ্টা করেছি।’

‘সেকেলে আমলের বন্দুক দিয়ে ভয় দেখিয়ে পাখিদের তাড়ানোর পদ্ধতি এখন আর কাজ করবে না। উড়োজাহাজে পাখির আঘাতের সমস্যাটি সমাধানের জন্য কর্তৃপক্ষের উচিত যত দ্রুত সম্ভব বিমানবন্দরে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা’, বলেন তিনি।

বিমানের সিইও ও এমডি এম মোকাব্বির হোসেন বলেন, ‘২০১৯ সালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমাদের অন্তত ২০টি উড়োজাহাজ পাখির আঘাতের শিকার হয়েছে।’

সূত্র বলছে, অন্যান্য এয়ারলাইনসগুলোও একই সমস্যার শিকার হয়েছে। কিন্তু, তাদের প্রকৃত সংখ্যা বলতে পারেনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। 

পাইলটদের মতে, পাখি যদি উড়োজাহাজের উইংস বা উইন্ডশিল্ডের নিচে থাকা ইঞ্জিনে আঘাত করে, তাহলে সেটির মেরামত খরচ খুবই ব্যয়বহুল। 

অ্যাভিয়েশন ওয়েবসাইটগুলোতে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, পাখির আঘাতের কারণে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক উড়োজাহাজগুলোর পেছনে প্রতি বছর এক দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার খরচ হয়।

উড়োজাহাজে পাখির আঘাতপ্রবণ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

বিভিন্ন এয়ারলাইনসের সূত্র জানিয়েছে, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের আশেপাশে বেশকিছু জলাশয় ও জলাভূমি রয়েছে, যা পাখিদের আমন্ত্রণ জানায়। পাশাপাশি শীতে যখন অতিথি পাখিরা আসে, তখন এই ধরনের ঘটনা ঘটার ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্র বলছে, বিমানবন্দরের উত্তর দিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একটি বর্জ্য ফেলার স্থান রয়েছে এবং পাখিরা খাবার খোঁজার জন্যে সেখানে ওড়াউড়ি করে থাকে। চূড়ান্ত অভিগমনের সময় উড়োজাহাজগুলোও ঠিক সেই স্থান দিয়েই যায়।

আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উড়োজাহাজে পাখির আঘাতের ৯০ শতাংশ ঘটনাই বিমানবন্দরের আশেপাশে ঘটে থাকে।

বিমানবন্দরে পাখি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করা একটি কোম্পানির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, উড়োজাহাজে আঘাত করা এসব পাখিদের সিংহভাগই অজানা প্রজাতির। আর এদের মধ্যে মাছশিকারী পাখি ২২ শতাংশ; শোর পাখি ১১ শতাংশ; বাজ, ঈগল ও শকুনের মতো র‌্যাপ্টর্স পাখি নয় শতাংশ; কবুতর, ঘুঘু ও সুইফটস পাখি নয় শতাংশ এবং হাঁস, রাজহংসী ও রাজহাঁস দুই শতাংশ।

২০১৯ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এশিয়া প্যাসিফিক ওয়াইল্ডলাইফ হ্যাজার্ড ম্যানেজম্যান্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশ তার ন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন ওয়াইল্ডলাইফ কন্ট্রোল কমিটির অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেছিল।

উপস্থাপনায় বলা হয়েছিল, বিমানবন্দর এবং এর আশেপাশে পাখির আঘাতের ঘটনা এদেশে একটি সাধারণ ঘটনা এবং ক্রমাগতভাব বাড়তে থাকায় এটি প্রশমনে বিমানবন্দর পরিচালনাকারীদের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল।

বিভিন্ন অনলাইন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিমানবন্দরগুলোতে উড়োজাহাজে পাখির আঘাতের ঘটনা বেড়েছে।

কর্তৃপক্ষ কী বলছে

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল-আহসান সম্প্রতি বলেছেন, ‘পাখি তাড়ানোর জন্য আমাদের ছয়টি বন্দুক রয়েছে। কিন্তু, এর মধ্যে চারটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে আছে এবং সেগুলোর আর মেরামত করার মতো অবস্থাও নেই। আমাদের শুটাররা বাকি দুটো দিয়েই পাখি তাড়ানোর কাজ করছেন।’

‘আকাশে পাখি দেখলে আমাদের দুই জন শুটার বিমানবন্দরের এক কোণা থেকে অন্য কোণায় চলে যায়’, বলেন তিনি।

তৌহিদ-উল-আহসান বলেন, ‘উড়োজাহাজে পাখির আঘাতের ঘটনা একটি বৈশ্বিক সমস্যা।’ নতুন বন্দুক কেনার প্রক্রিয়া চলমান বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা লাইসেন্সের জন্য জুনে (গত বছরের) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি।’

পাখি তাড়াতে বিমানবন্দরে থাকা দুটি অটোমেটেড যন্ত্র ‘দীর্ঘদিন যাবৎ’ অকার্যকর থাকার বিষয়টিও স্বীকার করেছেন বিমানবন্দরের পরিচালক।

তৌহিদ-উল-আহসান বলেন, ‘বিমানবন্দরে থাকা পাখি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করতে ও তাড়াতে আধুনিক বার্ড মনিটরিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম কেনার প্রক্রিয়া আমরা শুরু করেছি।’

পাখি তাড়ানোর আধুনিক যন্ত্র ও পর্যাপ্ত পরিমাণ বন্দুক না থাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনায় মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রানওয়েতে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি ওড়াউড়ি করে না। যখন এক বা দুটি পাখি ওড়াউড়ি করে, তখন শুটাররা সেগুলোকে তাড়াতে ছুটে যায়।’

‘শুটাররা বিমানবন্দর টাওয়ারের সঙ্গে সমন্বয় করেও কাজ করে থাকে। মাঝেমধ্যে পাখিগুলোকে মারা হয়, আবার মাঝেমধ্যে আকাশে ফাঁকা গুলি করে সেগুলোকে তাড়ানো হয়’, বলেন তিনি।

তবে, সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বন্দুকের গুলির শব্দ প্রায়ই কার্যকরভাবে কাজ করে না। কারণ, ওই এলাকার পাখিরা শব্দের সঙ্গেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

বিমানের সিইও মোকাব্বির হোসেন জানিয়েছেন, তারা বিষয়টি সিএএবিকে জানিয়ে আসছেন।

তিনি বলেন, ‘পাখিদের তাড়াতে যখন একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিই অনুসরণ করা হবে, তখন সেটি কিছুদিন পরেই আর কাজ করে না। কারণ, পাখিরা সেটার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাই কার্যকর ফল পেতে হলে একাধিক পদ্ধতি থাকতে হবে।’

অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিএএবির উচিত পাখিরা যাতে বিকল্প বসত ও খাদ্যক্ষেত্র অনুসন্ধান করতে পারে, সেজন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া। যেমন: বীজ বহনকারী প্ল্যান্টের মতো খাদ্যের উৎস সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, যেসব পোকামাকড় পাখিরা খায়, সেগুলো আশেপাশে না রাখা; পুকুর থাকলে সেগুলো জাল দিয়ে ঢেকে দেওয়া, যাতে পাখিরা সেখানে নামতে না পারে এবং পাখিরা যাতে গাছে বসতে এবং বাসা বানাতে না পারে, তা নিশ্চিত করা।

সিএএবির সদস্য (অপারেসন্স অ্যান্ড প্ল্যানিং) এয়ার কমোডর মো. খালিদ হোসেন সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা সমস্যাটির সমাধানে আধুনিক ও উন্নততর পদ্ধতি খোঁজার চেষ্টা করছেন।

তিনি বলেন, ‘বার্ড মনিটরিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম কেনার জন্য দরপত্র চূড়ান্তে একটি কমিটি কাজ করছে। আমরা কমিটির কাছ থেকে প্রতিবেদন পেলে তৎক্ষণাৎ দরপত্র নিলামের আহ্বান জানাব।’

সিএএবি কেন বন্দুকসহ পাখি তাড়ানো অন্য যন্ত্রগুলো মেরামত করছে না, জানতে চাইলে তিনি জানান, সরঞ্জামগুলোর সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঝামেলাসহ নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি তারা রয়েছেন।

‘সৎভাবে বলতে গেলে, বর্তমানে থাকা ব্যবস্থা খুব কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নয়’, যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago