মার্শাল আর্টই তাদের নিরাপত্তার ভরসা

নানা বাধার মাঝেও মার্শাল আর্টের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে লালমনিরহাটের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের তিন বোন। ছবি: স্টার

চারপাশে ধর্ষণ-নিপীড়ন বা এ ধরনের ঘটনা বাড়তে থাকায় অনেকটা নিরাপত্তা-ঝুঁকিতে রয়েছেন নারীরা। এমন সময়েই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ভার নিজেরাই সামলাচ্ছেন লালমনিরহাটের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের তিন বোন। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তারা শেখা শুরু করেন মার্শাল আর্ট। বর্তমানে শুধু নিজেরাই মার্শাল আর্ট চর্চা করছেন না, সহায়তা করছেন আশপাশের আরও অনেক নারীকেও।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে এই তিন বোন বলছিলেন, ‘আমাদের ভাই নেই। তাই মার্শাল আর্টই আমাদের নিরাপত্তার একমাত্র ভরসা। সে কারণে মার্শাল আর্টস শিখেছি, শিখছি আর চর্চা করছি প্রতিদিন। আমরা গ্রামে থাকি। আমাদের পরিবার গরিব। পড়াশোনার জন্য স্কুল-কলেজে যাতায়াত করতে আমাদের নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু, শুধু মার্শাল আর্ট জানার কারণেই আমরা নিজেদের নিরাপদ বলে মনে করি।’

তিন বোনের মধ্যে জান্নাতী খাতুন অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, খাদিজাতুল কোবরা মনি পড়ছে এইচএসসি প্রথম বর্ষে আর ছোট বোন ফাতেমা ইয়াসমিন পড়ছে পঞ্চম শ্রেণিতে। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কিসামত চন্দ্রপুর গ্রামে একটি দরিদ্র পরিবারে থেকে তারা পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হতে লড়াই করে যাচ্ছে।

তাদের বাবা জাফর উদ্দিন একজন দিনমজুর। মা রাশেদা বেগম ব্র্যাক পরিচালিত স্থানীয় একটি প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাদের রয়েছে চার শতাংশের একটি বসতভিটা। রয়েছে দুটি টিনের ঘর। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তিন মেয়েকে শিক্ষিত করছে পরিবারটি।

আত্মরক্ষার চিন্তা থেকে জান্নাতী খাতুন ২০১৭ সালে মার্শাল আর্ট শেখা শুরু করেন। পরে তিনি তার দুই ছোট বোন খাদিজাতুল কোবরা মনি ও ফাতেমা ইয়াসমিনকে মার্শাল আর্ট শেখান। এখন তিন বোন মিলে বাড়িতে প্রতিদিন মার্শাল আর্ট চর্চা করে। নিজেদের মধ্যে মার্শাল আর্ট নিয়ে প্রতিযোগিতাও হয়ে থাকে।

জান্নাতী খাতুন বাইসাইকেল চালিয়ে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। তার বোন খাদিজাতুল কোবরা মনিও বাইসাইকেল চালিয়ে ১২ কিলোমিটার দূরের একটি কলেজে পড়াশোনা করছে। ছোট বোন ফাতেমা ইয়াসমিন পড়ছে বাড়ির পাশের একটি বিদ্যালয়ে।

জান্নাতী খাতুন বলছিলেন, ‘মার্শাল আর্ট শুধু আত্মরক্ষার সুকবচ নয়, এটি দেহ ও মনকেও সতেজ-সবল রাখে। শরীরকে সুঠাম রাখতে মার্শাল আর্টের ভূমিকা রয়েছে। কাজের প্রতি কখনো অরুচি সৃষ্টি করে না। বরং কাজকে আরও গতিশীল করতে মার্শাল আর্ট অনুপ্রেরণা যুগিয়ে থাকে।’

‘আমাদের বাবা-মা কষ্টের মাঝেও আমাদের অুনপ্রেরণার উৎস। তারা আমাদের পড়াশোনার খরচ যোগাচ্ছেন। মার্শাল আর্ট চর্চা করতে কখনোই নিষেধ করেননি’, বলেন তিনি।

খাদিজাতুল কোবরা মনি জানায়, স্কুল-কলেজে যাতায়াতে এখন তারা অনেকটাই নিরাপদ। কিন্তু, পারিবারিক আর্থিক কষ্টে তাদের পড়াশোনা অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে। তাদেরকে দেখে গ্রামের অনেক মেয়ে এখন মার্শাল আর্ট শেখার জন্য তাদের কাছে আসছে। ‘নারী শিক্ষার্থীরা সবাই যদি মার্শাল আর্ট জানে ও চর্চা করে, তাহলে তারা নিজের মতো করে বাঁচার অনুপ্রেরণা পাবে’, যোগ করেন মনি।

স্থানীয় কৃষক জামিনুর রহমানের মেয়ে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী জমিলা খাতুন বলেন, ‘জান্নাতী ও খাদিজা আপুর কাছে আমি ও গ্রামের আরও কয়েকজন মেয়ে মার্শাল আর্ট শিখছি। মার্শাল আর্ট সত্যিই আমাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে।’

স্থানীয কৃষক মজিদুল ইসলাম (৬৭) জানান, আগে নারীদের মার্শাল আর্ট তারা পছন্দ করতেন না। কিন্তু, সময়ের প্রয়োজনে এটি তাদের জন্য গুরুত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা মার্শাল আর্ট শিখেছে ও শিখছে, তাদেরকে এখন ভালো দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

তিন বোনের মা রাশেদা বেগম (৩৮) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মেয়েদের পড়াশোনার জন্য আমাদেরকে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। সামান্য আয় দিয়ে সংসারও ঠিকমতো চলে না। মেয়েদের চাহিদা মতো প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে, মা হিসেবে আমি আমার মেয়েদের নিয়ে গর্ববোধ করি। কারণ, তারা সুশৃঙ্খল জীবন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।’

Comments

The Daily Star  | English
Khaleda Zia calls for unity

‘Seize the moment to anchor democracy’

Urging people to remain united, BNP Chairperson Khaleda Zia has said the country must quickly seize the opportunity to institutionalise the democratic system.

3h ago