শিক্ষার্থীদের অর্জনে প্রতিষ্ঠানের সুনাম
রাজধানী ঢাকায় প্রতি পাঁচ দশমিক ৩৮ বর্গকিলোমিটারে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এই শহরে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যা ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে খ্যাত। সেই ঢাকা যদি বিশ্বের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃত হয়, তবে তা মোটেই কোনো কাকতালীয় ব্যাপার হবে না। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থানের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষাকে অনেক বেশি সহজলভ্য করে তুলেছে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। তবে, বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স হতাশাব্যঞ্জক। এ কারণেই আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান এত পেছনে।
সম্প্রতি সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে করা এক জরিপে দেখা যায়, প্রাথমিকভাবে তাদের সন্তুষ্টি নির্ভর করে চাকরির বাজারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কতটা প্রস্তুত করতে পারছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যান্ড ভ্যালু কতটা তার উপর। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে বিষয়টি ভুলতে বসেছেন তা হলো— শিক্ষার্থীদের সন্তুষ্টি নির্ভর করে ক্যাম্পাসের পরিবেশ এবং ক্যাম্পাসে তাদের কাটানো সময়ের উপর। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের সহযোগী শিক্ষাকে উত্সাহিত করার উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি নিরাপদ স্থানে পরিণত করতে হবে। জরিপে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়গুলো সন্তোষজনক নয়।
তারা আরও জানিয়েছেন, সামগ্রিকভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ক্লাসরুম, স্যানিটেশন এবং কম্পিউটার ল্যাবের মতো সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়। এগুলো কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য নয়। বরং এগুলো একেবারেই প্রাথমিক প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য। এই অবস্থায় বর্তমান সুবিধাগুলো বজায় রেখে প্রয়োজনীয় সুবিধা যোগ করার প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এখনো যদি একটি বিভাগের সব শিক্ষার্থী ১০ থেকে ১৫ বছর আগের কম্পিউটার ল্যাব, একটি ফটোকপি মেশিন বা লাইব্রেরি ব্যবহার করে, তবে নিশ্চিতভাবেই সেগুলো যথেষ্ট নয়।
একটি সামগ্রিক একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্সে ভৌত অবকাঠামো এবং সহজলভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে, বাণিজ্যিক ভবনে কিংবা ঢাকার উপকণ্ঠে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে সেই বিষয়গুলো নেই।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে প্রযুক্তিগত এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর তীব্র অভাব প্রত্যক্ষ হয়েছে। যখন অনলাইন শিক্ষাদানের বিষয়টি সামনে আসে তখন দেখা যায়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রযুক্তিগত কাঠামোর দিক থেকে অনেক বেশি দুর্বল। একটি বিস্তৃত প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল অবকাঠামো শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় বই, জার্নাল, প্রয়োজনীয় পাঠ্য উপকরণ, প্রেজেন্টেশন, পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও অনুষদের সদস্যদের সঙ্গে অনলাইন যোগাযোগের ব্যবস্থা করবে। এর মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের কোর্স নিবন্ধন, গ্রেডিং এবং দেশের যে কোনো জায়গা পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা থাকবে। একইসঙ্গে এই প্ল্যাটফর্ম সহায়তা করবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ডিজিটাল গ্রন্থাগার তৈরিতে। নতুন স্বাভাবিকের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে প্রযুক্তিগত ও ডিজিটাল অবকাঠামোগুলো স্থাপনের মাধ্যমে অনলাইন শিক্ষা হতে পারে খুবই সহজভাবে।
সুপ্রতিষ্ঠিত ভৌত ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে নিতে পারে। এটা এমন এক যুগ, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিশ্বের যে কোনো জায়গায় বসে অনলাইনে কোর্স করতে পারেন। যদি কোর্স ফি ঠিক থাকে এবং সামর্থ্যের মধ্যে থাকে তাহলে অনেক শিক্ষার্থী বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিতে পছন্দ করেন। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সঙ্গে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডিগ্রি অর্জন আরও সহজ হয়ে উঠবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রযুক্তিগত কৌশল পুনর্বিবেচনা করার জন্য এটাই সময়। এখন উন্নয়ন করতে না পারলে ডাইনোসরদের পথ অবলম্বন করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ওয়েবসাইটগুলোর তথ্য আপডেট করে না। ফলস্মরূপ, তারা টাইমস হায়ার এডুকেশনের মতো এজেন্সিগুলোর কাছে তাদের অর্জন তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনি। যদি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা সফল গবেষণা কাজ করে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সেগুলো তাদের নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে প্রদর্শন না করে, তাহলে গবেষণা কাজগুলো প্রাপ্য স্পটলাইট পাবে না।
বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বিদ্যমান জ্ঞান তৈরির সম্ভাবনাগুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের জন্য গবেষণামূলক ও সহযোগী কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বৃহত্তর বিনিয়োগ সম্পর্কে জাতীয় আলোচনা শুরু করতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা আবিষ্কারের জগতে প্রবেশ করতে পারে। যদি সত্যিই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শ্রেষ্ঠত্বের তালিকায় নিজেদের নাম লেখাতে চায়, তাহলে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের এমন একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স দিতে হবে যা ন্যূনতম সুবিধার চেয়ে অনেক ভালো হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য ব্যয় একমাত্র মানদণ্ড হওয়া উচিত না। সেখানে অবশ্যই কার্যকারিতাই প্রাধান্য পাওয়া দরকার।
আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতা করতে এবং র্যাংকিংয়ে সামনে এগিয়ে আসতে চাইলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের বৃহত্তম সম্পদ ব্যবহার করতে হবে। আর তাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো তাদের শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীরাই দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং তারপর বিদেশে গিয়ে সুপরিকল্পিত একাডেমিক পরিবেশে গবেষণা করেন। প্রায়শই তাদের চমৎকার সব গবেষণা কাজের সংবাদ আমরা পাই। এই শিক্ষার্থীদেরকেই দেশেই রাখার জন্য বিদেশের মতো একাডেমিক পরিবেশ তৈরি করার মাধ্যমে বাড়তি চেষ্টা করা কি উচিত না?
নাজিবা মোহাম্মদ আলতাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করছেন। ড. আন্দালিব পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। ড. আন্দালিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অনুষদের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এই নিবন্ধটি তৈরি করেন এবং অপ-এডের জন্য উপস্থাপন করেন। অপ-এডগুলো লেখা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ওপর আলোকপাতের মাধ্যমে এবং একে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে। ‘একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রকল্প’তে অবদান রাখতে ইচ্ছুক যে কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ড. আন্দালিবের সঙ্গে [email protected] মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments