নিউইয়র্ক টাইমসের বিশেষ প্রতিবেদন

​বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত ছিল যে সাংবাদিক

প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল ২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে
চৌধুরী মঈনুদ্দীন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

বাংলা খবরের কাগজে তার সঙ্গে যারা কাজ করতেন, তারা চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে শান্ত, ভদ্র, এবং বিচক্ষণ তরুণ হিসেবেই জানতেন। তার চেহারা ছিল অমায়িক, মুখ ভরা ছিল ছোট করে ছাটা পরিপাটি দাড়ি। অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম বলতে ছিল—মুসলিম ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের এক নেতার সঙ্গে তার প্রায়শ ফোনালাপ।

কিন্তু গত কিছুদিনের অনুসন্ধানে জানা গেল, সেই ফোনালাপ নিছক সাধারণ কিছু ছিল না। এর সূত্র ধরেই জানা গেল এই মঈনুদ্দীন হলেন কমান্ডোর মতো গুপ্ত ঘাতক একটি সংগঠনের প্রধান যারা ঢাকায় একটি ইটভাটায় শত শত বিশিষ্ট বাঙালি অধ্যাপক, ডাক্তার, আইনজীবী ও সাংবাদিককে হত্যা করেছে।

ডিসেম্বর ১৭ তারিখে শেষ হওয়া যুদ্ধের আগের তিন দিন ধরে খাকি প্যান্ট আর কালো সোয়েটারের উর্দি পরা এই আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাদের আটক করেছিল। সেই সময় যারা আটক হয়েছিলেন তারা বলেছেন, এদের লক্ষ্য ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করা, যারা পাকিস্তান থেকে একটি স্বাধীন ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে কাজ করেছেন।

অনেক বাঙালি মনে করেন তখনই যদি যুদ্ধ শেষ না হতো তাহলে আলবদর তাদের পরিকল্পনায় সফল হতো। ওই ইটভাটায় যে ১৫০টি মৃতদেহ পাওয়া গেছে তাদের অধিকাংশেরই ছিল নখ উপড়ানো এবং আঙুল কাটা। ইট ভাটার কাছের মাঠেই ২০টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে শত শত মানুষকে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এটা এখন স্পষ্ট যে আলবদর হলো বাঙালিদের দ্বারা তৈরি বাহিনী, পশ্চিম পাকিস্তানী কিংবা ভারত থেকে আসা বিহারীদের, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির উপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে, তাদের দ্বারা নয়।

‘পৃথিবীর এমন কিছু নেই যা আমাদের সঙ্গে ঘটেনি,’ বলছিলেন সম্পাদক এহতেশাম চৌধুরী, যার পত্রিকায় কাজ করতেন মঈনুদ্দীন।

আলবদর বাহিনী এহতেশাম চৌধুরীর ছোট ভাইকে অপহরণের পর হত্যা করে। সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত অফিসে অবস্থান করায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান এহতেশাম। আলবদর সদস্যরা সেই রাতে রাত বাড়িতে হানা দিয়েছিল।

‘যা ঘটেছে আমি যখন এটা ভাবি, আমার পা অসাড় হয়ে যায়,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি ভালো হতো, যদি তারা আমাদের নিচে চাপা পড়ে থাকত।’

নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট

এই আলবদর বাহিনী যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ গ্রুপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সজ্জিত ছিল এ ব্যাপারে অনেক তথ্য প্রমাণ উঠে আসছে এখন।

পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ডেস্কের উপর পাওয়া কিছু গোপনীয় কাগজে এই আলবদর বাহিনীর কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘ক্যাপ্টেন তাহির, আলবদরের জন্য গাড়ি’, ‘আলবদরের ব্যবহার’—তাড়াহুড়ো করে লেখা একটি কাগজের নোটে পাওয়া গেছে।

ক্যাপ্টেন তাহিরকে বলা হয়ে থাকে, রাজাকার ও বিহারী মিলিশিয়ার একজন কিংবদন্তীতুল্য পাকিস্তানী কমান্ডার যাদের মাধ্যমে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাঙালিদের উপর ত্রাস সৃষ্টি করত।

অন্য আরেকটি পাতায় লেখা রয়েছে ‘নিজাম উদ্দিন, মোটিভেটেড নিউজ’। নিজাম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন বাঙালি সাংবাদিক যিনি পাকিস্তানবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে সুবিদিত। যুদ্ধ শেষ হওয়ার দুই দিন আগে তাকে তার বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়। এছাড়া তার নামের পাশে পেন্সিল দিয়ে অজ্ঞাত বিশেষ এক ধরনের চিহ্ন আঁকা ছিল।

তবে হত্যাকারীরা কিছু ক্লু রেখে গেছে। রাতে কারফিউ চলাকালীন তারা তাদের টার্গেটকে তুলে নিয়ে যায়। তারা কখনোই নিজেদের পরিচয় দিত না। কড়া পাহারার মধ্যে দূরে নিয়ে গিয়ে তারা হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটায়।

যুদ্ধ শেষ হবার আগের দিন ঢাকা শহরের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে সেই ইটভাটার পাশে যে কৃষকদের বসবাস, তারা কালো সোয়েটার, খাকি প্যান্ট পরা লোকদের দেখেছেন অসংখ্য মানুষকে চোখ বেঁধে সারিবদ্ধভাবে ধরে নিয়ে যেতে। কিন্তু চোখ বাঁধা লোকগুলো কারা ছিলেন তা দেখার জন্য খুব কাছে যেতে পারেননি তারা।

হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন লোক সেখান থেকে বেঁচে ফিরতে সক্ষম হয়েছেন এই ঘটনার কথা বলার জন্য। পরিসংখ্যানের অধ্যাপক মোহাম্মদ রউফ ১৩ তারিখ ভোরবেলা দরজায় জোরে টোকার শব্দ শুনে জেগে উঠেছিলেন। উত্তর দিয়েছিলেন তার স্ত্রী। দরজায় দাঁড়ানো ১২ জন সশস্ত্র লোককে তিনি বলেছিলেন তার স্বামী বাসায় নেই, কিন্তু এরপরও তারা জোর করে ঘরে ঢুকে পড়ে।

‘তারা আমাকে কিছুই বলেনি। যতক্ষণ না তারা তাকে (স্বামীকে) পেয়েছে ততক্ষণ ঘর তল্লাশি করেছে’ বলেন মিসেস রউফ।

‘এরপর তারা তাকে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যায়।’

ভাগ্যক্রমে, রউফ যে পেস্ট্রিশপে কেনাকাটা করতেন সেই দোকানেরই এক কর্মচারীকে তার সঙ্গে একই ঘরে বন্দী রাখা হয়। শ্রী চন্দপাল নামের পেস্ট্রিশপের সেই কর্মচারী পরে আলবদরের দলে থাকা এক বন্ধুর মধ্যস্থতায় মুক্তি পায়।

‘ওখানে ৪২ জন ছিলাম আমরা সেই রুমে’ চন্দপাল বলেন, ‘আমাদের সবার হাত ছিল পিছমোড়া করে বাঁধা এবং চোখ কাপড়ে ঢাকা। একটা পর্যায়ে আমি চোখের বাঁধন আলগা করতে পারি। সেই রুমের অধিকাংশ লোক ছিলেন পেশায় অধ্যাপক এবং ডাক্তার। সেখানকার প্রহরীরা আমাদের কিছু খেতে দেয়নি। এমনকি আমরা যখন পানি চাইছিলাম তারা হেসে বলেছিল যাও ইন্দিরা গান্ধীকে বলো।’

চন্দপাল বলছিলেন, ওদের সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের আলোচনা শুনে আলবদরের বিষয়টি বুঝতে পারেন। ‘তারা বলছিল কেন বাঙালিদের হত্যা করা দরকার। আমরা অন্য ঘর থেকে চিৎকারের শব্দ শুনছিলাম।’

‘সেই রাতে প্রহরীরা প্রফেসর রউফসহ ১০ জনকে নিয়ে যায় যারা আর ফিরে আসেননি।’

ডিসেম্বর ১৫ তারিখ যখন চন্দপাল মুক্তি পান, তখন তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন ঢাকার শারীরিক শিক্ষা কলেজের একটি ডরমিটরিতে যা আমেরিকান সাহায্যে তৈরি করা আধুনিক ভবন ছিল।

কলেজের দারোয়ান মকবুল হোসাইনও সেই রাতগুলোর কথা মনে করেন। ‘সুন্দর কাপড় পরা এবং হাত বাঁধা অবস্থায় শত শত লোককে সেখানে নিয়ে আসা হতো। ওই ঘরগুলো থেকে আমরা সব সময় আর্তনাদ আর চিৎকার শুনতে পেতাম,’ বলেন তিনি।

আলবদর নামটি নেওয়া হয়েছে মদিনার কাছে যে জায়গায় ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে মহান যুদ্ধ করেছিলেন সেখান থেকে। তার (নবীর) অসংখ্য সাহসী সেনাকে এই নাম দেওয়া হয়েছিল।

ঢাকার জেলে আটক আছেন এরকম একজনের ভাষ্য অনুযায়ী, রিপোর্টার মঈনুদ্দীন ছিলেন এই আলবদরের মূল হোতা। মঈনুদ্দীনের সঙ্গে তার ঘরেই থাকত এরকম একজনের একটি ডায়রি পাওয়া গেছে যেখানে আলবদর বাহিনীর সদস্যদের নামের তালিকা এবং তারা কত টাকা চাঁদা দিয়েছিল তা উল্লেখ ছিল।

এই দুজন যে বাড়িটিতে থাকতেন তার সামনে ছিল ঢাকার জামায়াতে ইসলামীর সদর দপ্তর। মৌলবাদীদের এই দলটি গত বছর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে এক শতাংশের কম ভোট পেয়েছিল। আলবদর বাহিনী হলো জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয় এক শাখা সংগঠন যাদেরকে গত মার্চে পাক বাহিনীর দমন-পীড়ন শুরুর পর খুব সতর্কতার সঙ্গে বাছাই করা হয়েছে।

পূর্বদেশ পত্রিকার এক সহকর্মীর সঙ্গে তর্কাতর্কি হবার পর মঈনুদ্দীনকে ১৩ ডিসেম্বর শেষবারের মতো ঢাকায় দেখা গিয়েছিল। তার সেই সহকর্মীকে ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আলবদর সদস্যরা তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়।

সেই অফিসের আরেক কর্মী আতিকুর রহমান এখন মঈনুদ্দীনকে খুঁজতে শুরু করেছেন। রহমান বলেন, ‘আমরা তাকে খুঁজে বের করব, এর আগ পর্যন্ত আমরা শান্ত হব না।’

[চৌধুরী মঈনুদ্দীন বর্তমানে যুক্তরাজ্যের নাগরিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি হামিদুল হক চৌধুরীর মালিকানাধীন পূর্বদেশ পত্রিকায় কাজ করতেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।]

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago