উহানে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিনগুলির ভিডিও প্রকাশ

আলজাজিরার সংগৃহীত ভিডিওতে ২০২০ সালের ১৯-২২ জানুয়ারি
আল জাজিরার সংগৃহীত ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি।

চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে ২০১৯ এর ডিসেম্বরে নতুন ভাইরাসের সংক্রমণের খবর জানা যায়। এরপর থেকেই পাল্টে যেতে থাকে পুরো পৃথিবীর চিত্র। গত বছরের এই সময়ে উহানে কী হয়েছিল, মহামারি বিস্তারের প্রথম দিনগুলো কেমন ছিল, চীন সরকার কীভাবে সেসব সংবাদ প্রকাশে বাঁধা দিচ্ছিল- এসব নিয়েই দুই চীনা সাংবাদিকের ডায়েরি ও ভিডিও ফুটেজ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল জাজিরা।

গত বছরের জানুয়ারি মাসের ১৯ থেকে ২২ তারিখকে ওই দুই সাংবাদিক বলছেন ‘বিশ্বকে থমকে দেওয়া সেই তিন দিন’।

নিরপত্তার কারণে লুকিয়ে তারা ভিডিও করেছেন আর লিখে রেখেছেন তাদের ডায়েরিতে। উহানের প্রায় এক কোটি ১০ লাখ লোক প্রথম দিকে পাত্তাই দিচ্ছিলেন না ভাইরাসটিকে। কয়েকদিন পরেই যা আতঙ্কে পরিণত হয়। করোনা রোগীতে উপচে পড়ে হাসপাতালগুলো।

ফুটেজগুলো এর আগে প্রকাশিত হয়নি কোথাও, চীনে এটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। পরে, সাংবাদিকেরা আল জাজিরার কাছে হস্তান্তর করে সেগুলো।

লকডাউন শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে তারা উহানে যান। সরকারিভাবে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল তখন একশ জনেরও কম। ওই দুই সাংবাদিক শহরের হাসপাতালগুলোতে আর সেই সি-ফুড মার্কেটে ঘুরে ঘুরে বোঝার চেষ্টা করছিলেন যে উহানে আসলে কী চলছে। তবে, পদে পদে তাদের পড়তে হয়ে পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীদের বাধার মুখে।

সংকটের প্রাথমিক দিনগুলি

২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি দুই সাংবাদিক উহান পৌঁছান। তখনও ভাইরাসের তীব্রতা এবং একজন থেকে আরেকজনের সংক্রমণের বিষয়টি অজানা। যে কারণে করোনা ছড়াতে থাকলেও, শহরের বাসিন্দারা সেটিকে গ্রাহ্য করছিলেন না। কাউকে মাস্ক পরতে দেখা যাচ্ছিল না তখন।

ডায়েরিতে এক সাংবাদিক লিখেছেন, 'পৌঁছে দেখি লোকেদের ভাইরাস নিয়ে মোটেই কোনও ভয় বা উদ্বেগ নেই। অনেকে তো ভাইরাসের খবরই জানে না।'

অনেকে এটাকে ফ্লু'র চেয়ে মারাত্মক ভাবলেও, সার্সের চেয়ে হালকাভাবে নিচ্ছিলেন।

'একজন দোকানদার আমাকে মাস্ক খুলে ফেলতে বলেন। সেখানে সবকিছু ঠিকঠাক আছে এবং আমি বাইরে থেকে এসেছি বলে শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা করছি বলেও জানান তিনি।’

হুয়ানান সি-ফুড মার্কেটটি অবশ্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ভাইরাসের উত্স সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করেছে। তবে, উহান বা বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে কোনও তথ্য দিচ্ছিলেন না। নাগরিকেরা ছিলেন অন্ধকারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে সচেতন করলেও, ভাইরাসটি ছোঁয়াচে ছিল, চীন কিংবা ডব্লিউএইচও কেউই তা জানত না।

আসন্ন চীনা নববর্ষ উদযাপন করতে লাখ লাখ মানুষ চীনে ভ্রমণ করছিল। সেসময় সরকার উহানে লকডাউন ঘোষণা করে। রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। সবাই মাস্ক পরতে শুরু করে। বন্ধ হয়ে যায় জনসমাগমের স্থানগুলো।

কিন্তু, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। প্রথমে চীনে, আর কয়েকদিনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে।

প্রথম দিনগুলোতে চীন সরকারের তথ্য প্রকাশ ও স্বচ্ছতার অভাব ভাইরাসটির দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। সাংবাদিক তার ডায়েরিতে লিখছেন, 'উহানে স্বাস্থ্যকর্মী ও সরঞ্জামের অভাবে আক্রান্ত অনেক রোগী চিকিত্সা বঞ্চিত হচ্ছে।'

হাসপাতালগুলো প্রকৃত ঘটনা লুকিয়ে রেখেছে বলেও ডায়েরিতে উঠে এসেছে।

সরকারি সেন্সরশিপ

ফুটেজ ও ডায়েরিতে দেখা যায় কীভাবে কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের তাদের কাজে বাধা দিচ্ছিল। যদিও বেইজিংয়ের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে কাজ করার ও উহানের মিউনিসিপ্যাল  মিডিয়া অ্যাফেয়ার্স থেকে তাদের কাজের অনুমতি ছিল।

প্রতিবেদন তৈরির প্রতিটি পর্যায়ে- সি-ফুড মার্কেট, হাসপাতাল সবখানেই পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে।

ডায়েরিতে সাংবাদিক লিখেছেন, 'স্বাধীনভাবে রিপোর্ট করতে পারছি না। সরকারি প্রতিষ্ঠান মানেই গুপ্তচরবৃত্তি করে তথ্য সংগ্রহ করা লাগছে।'

'ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে তথ্য গোপন রাখা হচ্ছে। এগুলো পাওয়া খুব কঠিন।'

তিনি আরও লিখেছেন, 'উহানে প্রতিবেদন তৈরির তিন দিন পুলিশ ও হাসপাতাল কর্মীরা বারবার আটকাচ্ছিল। আমি ভাইরাসের ভয়াবহতা বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, এটা নিয়ে প্রতিবেদন করা কতটা স্পর্শকাতর ও কঠিন। যা আমার ধারণার বাইরে।'

পুলিশ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের ভিডিও করতে নিষেধ করছিলেন।

আরেক সাংবাদিক তার ডায়েরিতে লিখেছেন, 'কিছু বিষয় চীনের কোনও প্রতিবেদনে আসেনি। যেমন, মহামারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা, সংক্রমিত রোগীদের জন্য প্রোটোকল কিংবা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি দপ্তরগুলো সম্পর্কিত কোনও কিছু। এগুলো নিয়ে রিপোর্ট করা অসম্ভব।'

করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে অন্তত নয় জন চীনা সাংবাদিক গ্রেপ্তার বা নিখোঁজ হয়েছেন। ডিসেম্বরে নাগরিক সাংবাদিক ভাইরাস নিয়ে প্রতিবেদনের জন্য ঝাং ঝানকে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, 'চীনা মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চীন বাদে বাকি বিশ্বের সংকট নিয়ে কথা বলেছে। চীনে ভাইরাসের উদ্ভব বা উহানের স্থানীয় সরকারের শুরুর দিকের ভুল নিয়ে কথা বলার সাহস করেনি কেউ।'

'সরকারের ভাল কাজ এবং চীনা জনগণ সরকারের প্রতি কতটা কৃতজ্ঞ, কেবল তা নিয়েই আলোচনার অনুমতি দেওয়া হয়।'

'বিশ্ব থমকে দেওয়া সেই তিন দিন' এর পরের ঘটনা সবার জানা। চীন ছাড়িয়ে একের পর এক দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো করোনাভাইরাস। এ পর্যন্ত ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের প্রায় সাড়ে নয় কোটি মানুষ, মারা গেছেন ২০ লাখেরও বেশি।

ভাইরাস প্রতিরোধে কয়েকটি ভ্যাকসিনও চলে এসেছে ইতোমধ্যে। বেশকিছু দেশে লোকেদের ভ্যাকসিন দেওয়াও শুরু হয়েছে।

বর্তমানের উহান নিয়ে সাংবাদিক তার ডায়েরিতে লিখেছেন, 'এখন লোকেরা আর ভাইরাস নিয়ে কথা বলে না। যেন এটি অনেক দিনের পুরোনো ইতিহাস।’

তিনি লিখেছেন, 'চীনা জনগণ নিজেদের খুব ভাগ্যবান ও গর্বিত বোধ করে। কারণ, তারা মনে করে এটিই একমাত্র দেশ যারা ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে।'

'বেশিরভাগ চীনাদের ধারণা এমন হলেও, এটি হয়তো সত্য নয়।'

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য আল-জাজিরাকে বলেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে মহামারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।

তবে, সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় অভিযোগ করা হয়েছে যে চীনা সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারলে, ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম হতো।

সাংবাদিকতার স্বাধীনতা বিষয়ক আল জাজিরার প্রশ্নের জবাবও দেয়নি চীনা সরকার।

Comments

The Daily Star  | English
gold price hike in Bangladesh

Why gold costs more in Bangladesh than in India, Dubai

According to market data, gold now sells for $1,414 per bhori in Bangladesh, compared to $1,189 in India, $1,137 in Dubai

2h ago