কতজন শিক্ষার্থী তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে চায় এবং কেন?
আমাদের সরকারি বা বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কি কখনো তাদের শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চায় নিজ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে তারা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে কিনা? আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ করব, শিক্ষার্থীদের অন্তত একবার এই প্রশ্নটি তাদের করতে। এতে করে অনেক আশা, আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মনে কী আছে, তা জানা সম্ভব। দুর্ভাগ্যক্রমে অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই তাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন পরিণত হয়েছে হতাশা, আফসোস আর অসন্তুষ্টিতে।
একটি জরিপে শিক্ষার্থীদের কাছে আমরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যেতে চায় কিনা তা জানতে চেয়েছিলাম। এর ফলাফল কী আসবে সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। তবে ফলাফল হাতে পেয়ে বিস্মিত হয়েছ! বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা ৩৫৮ জন উত্তরদাতার মধ্যে ৩৫ শতাংশই উত্তর দিয়েছেন ‘হ্যাঁ’। গড়ে প্রতি তিন জন শিক্ষার্থীর একজন তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যেতে চান। এই সংখ্যাটি শিক্ষার্থীদের একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স কেমন তার আন্দাজ দেয়।
একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কিছু মন্তব্য দেখে নেওয়া যাক। এক শিক্ষার্থী জানান, তার প্রতিষ্ঠানটি কল্পনাশক্তিহীন, গতানুগতিক। ‘আমি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দিতে দিতে ক্লান্ত। কেউ নতুন ধারণা বা উদ্ভাবনের বিষয়ে কথা বলে না।’
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের মূল ফোকাস শিক্ষার্থীদের ওপরেও নেই, গবেষণায়ও নেই। আর আর্টিকেল, (কিছু) শিক্ষকদের রিসার্চগুলো মূলত শিক্ষার্থীদের কাজ থেকেই কপি করা, কোনো আসল আর্টিকেল না। কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কথা শুনতে চায় না।’
শিক্ষার্থীদের মন্তব্যগুলো এমন হতাশার পাশাপাশি তাদের অভিযোগও প্রকাশ করেছে। যদি অনুষদ ও একাডেমিক প্রশাসকরা এগুলো শুনতেন! শিক্ষার্থী ভর্তি, তাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, সার্টিফিকেট দেওয়া এবং উৎসাহমূলক বক্তব্য দেওয়া ছাড়া তেমন বেশি কিছু হয় না বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর থেকে একজন ধারণা করতেই পারেন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কতটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। হাতে গোনা কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান ও ভবিষ্যতের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা দিচ্ছে।
কোথায় ভর্তি হবে বা কোন বিষয়ে পড়াশুনা করবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যথেষ্ট সময় নেয় শিক্ষার্থীরা। কারণ, শিক্ষা জীবনের বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বাবা-মা, বড় ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুরা এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ দেন। একজন শিক্ষার্থী তার সিদ্ধান্তে আত্মবিশ্বাসী হয়েই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এমন হয় না। আমরা জরিপের ফলাফল আরও গভীর পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাই, ছেলে এবং মেয়ে শিক্ষার্থী সমহারে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে চান। ছেলে শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্সের নম্বর দিয়েছে সাত এর মধ্যে চার দশমিক ৪৮ এবং মেয়ে শিক্ষার্থীরা দিয়েছে চার দশমিক ৩৮।
এক অর্থে শিক্ষার্থীরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ‘ক্রেতা’। ফলে তাদের কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দায়বদ্ধতা। একাডেমিক প্রোগ্রামে একতরফা ভাবে শুধু শিক্ষকরা দিয়ে যাবেন আর শিক্ষার্থীরা নিয়ে যাবেন, এমন হওয়া উচিৎ না। এর বদলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিৎ শিক্ষার্থীদের কথা শোনা এবং তাদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে লক্ষ্য পূরণে সর্বাত্মক সহায়তা করা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন সংকট আরেকটি সমস্যা। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে বেশি কাঙ্ক্ষিত বিষয় হচ্ছে- ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিকেল। তাদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষার্থীই অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এসব বিষয়ে পড়ার সুযোগ পায়। পছন্দসই অন্যান্য বিষয়ের জন্যও আসন সীমিত। ফলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই তাদের পছন্দের নয় এমন বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করে। এর ফলে তাদের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছায় ঘাটতি দেখা দেয়।
যে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় বা বিষয়ে ভর্তি হন, তাদের সন্তুষ্টিও এমনি এমনি তৈরি হয় না। তাদের সন্তুষ্টি তৈরি হওয়ার বেশ কিছু কারণ থাকে। তার মধ্যে রয়েছে- শিক্ষার মান, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক, ক্যাম্পাসের পরিবেশ, ক্যারিয়ারের দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি। তাদের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে কোনো অন্তরায় থাকলেই তাদের ভেতরে অসন্তুষ্টি তৈরি হতে শুরু করে।
এটি অবশ্যই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে কোভিড যুগে দূরবর্তী শিক্ষা বাস্তবে পরিণত হয়েছে। যারা দূরবর্তী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে তারা প্রযুক্তির প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষা অর্জনের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারবে। এতে করে আরও ভালো শিক্ষা পেতে একটি ভালো সংখ্যক শিক্ষার্থী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে চলে যাবে। সঙ্গে আমরা হারাব মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা।
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন, একজন শিক্ষার্থী কতটা অসন্তুষ্ট হলে তার একাডেমিক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করা উচিত? আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চ মানের একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তবে এগুলো অবশ্যই সমাধান করতে হবে। মূল বিষয় হলো- শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে প্রত্যাশার ব্যবধানটি বোঝা। তারপর এই ব্যবধান কমানোর উপায়গুলো অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পৃথক জরিপের পাশাপাশি বৃহৎ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সন্তুষ্টির বিষয়ে জরিপ করা হলে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের জরিপ করা হলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট সমস্যা চিহ্নিত করা যাবে। আর বৃহৎ পর্যায়ের জরিপে সামগ্রিক সমস্যাগুলো উঠে আসবে।
শিক্ষার্থীরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয় তার সত্যিকারের মূল্যায়ন হয়ে গেলে, সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিয়ে বড় ও মূল সমস্যাগুলো সমাধানে চেষ্টা করা সম্ভব। পর্যায়ক্রমে সব সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স প্রায় ৪০০ বছর। সেটি এখনও নিয়মিতভাবে তাদের উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
দেশের সার্বিক উন্নয়নে উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব অসীম। শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যখন তাদের একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি অসন্তুষ্টি থেকে বের হয়ে যেতে চায়, তখন বুঝতে হবে কিছু একটা সমস্যা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনেক টাকা খরচ করে পড়ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং নীতি নির্ধারকদের অবশ্যই এই খরচ বৃথা যেতে না দেওয়ার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এখনই সময় শিক্ষার্থীদের কথা শোনার এবং তাদেরকে ইতিবাচক একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করার।
মো. উমর ফারুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করছেন। ড. আন্দালিব পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। ড. আন্দালিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অনুষদের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এই নিবন্ধটি তৈরি করেন এবং অপ-এডের জন্য উপস্থাপন করেন। অপ-এডগুলো লেখা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ওপর আলোকপাতের মাধ্যমে এবং একে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে। ‘একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রকল্প’তে অবদান রাখতে ইচ্ছুক যে কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ড. আন্দালিবের সঙ্গে [email protected] মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments