‘বাপি তুমি কোথায়, খুব মিস করছি তোমায়’
‘এই সব সেলাই ফোঁড়াই কুরুশের কাজ
কে এসে থামিয়ে দিয়ে বলল
জীবনের একমাত্র নিশ্চয়তা মৃত্যু
এবার যেতে হবে!’
এ কবিতাটি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা। তার জন্মদিনে কেনো এই কবিতাটা মনে হলো ঠিক জানি না। বেঁচে থাকলে মনে পড়তো কি? না কি মনে পড়তো না। হয়তো তার লেখা অন্য কোনো কবিতার কথা মনে হতো।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মেয়ে পৌলমী বসু বাবাহীন প্রথম জন্মদিনে তার ফেসবুক দেয়ালে লিখেছেন, ‘আজ এতো মন খারাপ হবে সেটাই ভাবতে পারিনি। রাশিরাশি মন খারাপ কোথা থেকে যেন এসে আমায় গ্রাস করেছে। বাপি... তুমি কোথায়… খুব মিস করছি তোমায়, আজ আর কিছু ভালো লাগছে না!’
কিংবদন্তি এই অভিনয়শিল্পীর জন্মদিন আজ। জীবনের ওপারে চলে যাওয়ার পর প্রথম জন্মদিন। বেঁচে থাকলে ৮৬ বছরে পা রাখতেন সবার প্রিয় ‘অপু’, ‘ফেলুদা’ কিংবা ‘উদয়ন পণ্ডিত’।
১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। প্রতিদিন নতুন আলোর স্বপ্ন দেখাতেন এই বরেণ্য মানুষটি।
একবার জন্মের পর ৯ আগস্ট ১৯৫৮ সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আবার ‘নতুন জন্ম’ হয়েছিল। কেননা, সেদিন তিনি সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরার সামনে প্রথম দাঁড়িয়েছিলেন ‘অপু’ হয়ে।
দর্শক নন্দিত এই অভিনেতা ১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘অপুর সংসার’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেছিলেন। তারপর সত্যজিতের পরিচালনায় ১৪টি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। ছবিগুলোর মধ্য রয়েছে: ‘দেবী’, ‘তিনকন্যা’, ‘অভিযান’, ‘চারুলতা’, ‘কাপুরুষ’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘অশনি সংকেত’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’,‘গণ শত্রু’ ও ‘শাখা প্রশাখা’।
শুধু সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনা শুধু নয় তপন সিনহা, মৃণাল সেন থেকে শুরু করে তার পরের প্রজন্ম ও নতুন প্রজন্মের পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছিলেন সৌমিত্র।
ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘অসুখ’, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘হেমলক সোসাইটি’, গৌতম ঘোষের ‘দেখা’ ও ‘আবার অরণ্যে, নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘বেলা শেষে’ ও ‘পোস্ত’ এবং অতনু ঘোষের ‘ময়ূরাক্ষী’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন তিনি।
দর্শকের আবেগের এক নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে বারবার ভেঙেছেন, গড়েছেন তিনি। তার অভিনীত আলোচিত সিনেমার অন্যতম সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অপুর সংসার’। এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৯ সালে। এর মাধ্যমেই বড় পর্দায় হাতেখড়ি হয়েছিল তার। ‘অশনি সংকেত’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে। ছবিটিতে তার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের ববিতা।
১৯৬৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল ’চারুলতা’। এই ছবিতে সৌমিত্রের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৮ সালে। দিনেন গুপ্ত পরিচালিত ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৩ সালে। এতে তার বিপরীতে ছিলেন অপর্ণা সেন।
১৯৬৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল অজয় কর পরিচালিত ‘সাত পাকে বাঁধা’। এই ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন সুচিত্রা সেন।
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘সোনার কেল্লা’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৮ সালে। এতে সৌমিত্রকে ফেলুদার চরিত্রে দেখা যায়। ১৯৭৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘দেবদাস’। এতে তিনি দেবদাসের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তার বিপরীতে ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী।
১৯৮০ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘হীরক রাজার দেশে’। ‘গুপী বাঘা’ সিরিজের এই গল্পে তাকে বিশেষ ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও মঞ্চ ছিল তার প্রাণের জায়গা। তিনি মঞ্চেই শ্বাস নিতেন। মঞ্চে অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক পরিচালনা করেছেন তিনি। মঞ্চে তার অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম: ‘নাম জীবন’, ‘রাজকুমার’, ‘ফেরা’, ‘নীলকণ্ঠ’, ‘ঘটক বিদায়’, ‘ন্যায় মূর্তি’, ‘টিকটিকি’ ও ‘রাজা লিয়ার’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেনাপাওনা’ ও ‘স্ত্রীর পত্র’ পরিচালনা করেছিলেন তিনি। মঞ্চকে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সমৃদ্ধ করেছেন সৌমিত্র।
অভিনেতা, নায়ক ও আবৃত্তিকারের ভূবন ছাড়িয়ে একজন জীবনের কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ‘এক্ষণ’ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। তার রয়েছে কবিতাসমগ্র।
তিনি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৯১ সালে। ‘অন্তর্ধান’ ছবির জন্য পেয়েছিলেন বিশেষ জুরি সম্মান। নয় বছর পরে একই সম্মান পান ‘দেখা’ চলচ্চিত্রের জন্য। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে সম্মানিত হতে তার সময় লেগেছিল আরও ১৫ বছর।
অভিনয়জীবনের পাঁচ দশক পেরিয়ে ২০০৬ সালে ‘পদক্ষেপ’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে সম্মানিত হয়েছিলেন সৌমিত্র। ২০১২ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পেয়েছিলেন।
২০০৪ সালে তাকে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করা হয়। সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারের পালক তার মুকুটে যোগ হয়েছিল ২০১২ সালে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর টানা ৪০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে ৮৫ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন।
Comments