মুক্তিযুদ্ধ ও নাট্যাঙ্গনে উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে থাকবেন মুজিবুর রহমান দিলু
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রখ্যাত নাট্যজন মুজিবুর রহমান দিলু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৭৭ সালে ঢাকা ড্রামা নাট্যদল প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও তার দাদা ও নানার বাড়ি নোয়াখালী, বাবার চাকরির সুবাদে ১৯৫২ সালের ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে তার জন্ম।
মুজিবুর রহমান দিলু চট্টগ্রামের ওয়েস্ট এন্ড স্কুলের ছাত্র ছিলেন। স্কুলের স্কাউট দলের সদস্য হিসেবে ১৯৭০ সালে ঢাকার মৌচাকে পাকিস্তানের সর্বশেষ স্কাউট জাম্বুরিতে অংশ নিয়েছিলেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে। আপাদমস্তক একজন সৃজনশীল শিল্পী ছিলেন মুজিবুর রহমান দিলু। অসীম সাহসী, পরিশ্রমী ও চিন্তাশীল এ মানুষটি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন স্মার্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থাতেই তৎকালীন ঢাকার বিখ্যাত হোটেল পূর্বাণীতে চাকরি শুরু করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে মুজিবুর রহমান দিলু ১৯৭২ সালে বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে অভিনয় শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় নাট্য উৎসবে নির্দেশনা দেন নাটক ‘কিংসুক যে মরু’তে। তার নির্দেশিত মঞ্চ নাটক হচ্ছে— ‘কড়াদাম চড়াদাম’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’, ‘আমি গাধা বলছি’, ‘নানা রঙের দিন গুলি’। মঞ্চ ও টিভির বহু নাটকে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। তার অভিনীত নাটকগুলো হচ্ছে— ‘তথাপি’, ‘সময় অসময়’, ‘সংশপ্তক’, ‘জনতার রঙ্গশালা’ ইত্যাদি। নির্দেশনা ও অভিনয় দুটোতেই সমান পারঙ্গম ছিলেন। টিভি নাটকের মধ্যে ‘নীল পানিয়া’, ‘মহাপ্রস্থান’, ‘কিছু তো বলুন’, ‘তথাপি’, ‘আরেক ফাল্গুন’ উল্লেখযোগ্য। বিটিভির ধারাবাহিক— ‘সময় অসময়’ এবং ‘সংশপ্তক’। তার অভিনীত ‘সংশপ্তক’র মালু চরিত্রটি আজও দর্শকদের মনে দাগ কেটে আছে।
হোটেল পূর্বাণী ছাড়াও মুজিবুর রহমান দিলু কাজ করেছেন— বৈশাখী টিভি, শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন, দৈনিক আজকের প্রত্যাশা ও শান্ত-মারিয়াম একাডেমি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে।
থিয়েটারের প্রতি নিবেদিত প্রাণ এ মানুষটি হোটেল পূর্বাণীতে উঁচু পদে থাকা অবস্থায় শিশুদের জন্য ‘টোনাটুনি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সংগঠনটির সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। শিশুদের নিয়ে আরও নানা রকম কাজ করেছেন। আশির দশকে ছোটদের জনপ্রিয় গল্প ও সংগীতের সমন্বয়ে শ্রুতি নাটক ‘টোনাটুনি’ প্রকল্পের নির্দেশক ছিলেন। শিশুদের জন্য টোনাটুনির প্রায় সব প্রযোজনা বলা যায় তার হাতেই হয়েছিল। ২০০৫ সালে নাটক নিয়ে ভারতে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বন্ধুদের সহযোগিতা ও সরকারি অনুদানে ব্যয়বহুল চিকিৎসা শেষে আবার নাট্যাঙ্গনে ফিরে আসেন।
বহুবিধ বিষয়ে পড়াশোনা করতেন মুজিবুর রহমান দিলু। দেশি-বিদেশি গল্প-উপন্যাস, মনীষীদের জীবনী তার নখদর্পণে ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী।
ছয় ভাই ও দুই বোনের পরিবারে মুজিবুর রহমান দিলু ছিলেন ভাইদের মধ্যে চতুর্থ। পারিবারিক জীবনে দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। তারা ছয় ভাই হলেন— প্রখ্যাত নাট্যজন মঞ্চসারথী আতাউর রহমার, জাহিদুর রহমান, সাজিদুর রহমান (কবি মেহরাব), নাট্যজন মুজিবুর রহমান দিলু, নাঈম সাইফুর রহমান ও নোমান মাহমুদুর রহমান। দুই বোন যোবায়দা জেবু ও খুরশিদা বেগম।
১৯৭৮ সালে ‘পদাতিক নাট্য সংসদ’ প্রতিষ্ঠার পর টিএসসিতে নিয়মিত মহড়ায় তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। তিনি আমাদের মহড়াঙ্গনের প্রাণ ছিলেন। ছোট-বড় সবার সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতেন। রাজপথের আন্দোলন, বন্যা দুর্গতদের ত্রাণ, দুর্যোগ-দুঃসময়ে সব জায়গায়ই আমরা তাকে পাশে পেয়েছি। বিদায় প্রিয় দিলু ভাই, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও নাট্যাঙ্গনে উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
সেলিম শামসুল হুদা চৌধুরী: সংবাদপত্রসেবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক
Comments