অযৌক্তিকভাবে অবহেলিত শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং
একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্ট ইতোমধ্যে বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছে, যেগুলোর প্রতি উচ্চশিক্ষার নীতিনির্ধারক এবং প্রশাসকদের আরও বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। এর মধ্যে আছে একাডেমিক প্রোগ্রামগুলোর প্রাসঙ্গিকতা, শেখার আনন্দ, অনুষদের আচরণ, শিক্ষার্থীদের সখ্যতা, শিক্ষার্থীদের আবাসন এবং শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া বন্ধ করা।
আরও একটি বিষয় আছে যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও অযৌক্তিকভাবে অবহেলা করা হয়। সেটি হলো- শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং পরামর্শ বা কাউন্সিলিংয়ের অভাব। একাডেমিক চাপ, একাকিত্ব, ক্লান্তি, হয়রানি, খাবার, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উদ্বেগ, আর্থিক সমস্যা, সম্পর্কজনিত সমস্যা, বাড়ির সমস্যা, সহিংসতা, হতাশাসহ আরও অনেক ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা। উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম আমাদের দেশে প্রায় কয়েক দশক ধরে চলছে। তবে, শিক্ষার্থীদের যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় এবং এর ফলস্বরূপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব পরে সে সম্পর্কে যত্ন নেওয়ার বিষয়টি সযত্নে অবহেলিত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এটাই আমাদের জাতির ভবিষ্যত নির্মাতাদের দুর্ভাগ্য।
বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার জন্য তাদের বাবা-মা এবং বাড়ি থেকে অনেক দূরে যেতে হয়। তাদের হঠাৎ করেই একেবারে নতুন পরিবেশে এসে সবার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হয় এবং নতুন পরিবেশে চলতে হয়। বয়স কম থাকে। পড়াশোনা ছাড়াও বিভিন্ন কাজে তারা জড়িয়ে পরে। কিছু শিক্ষার্থীকে তাদের পরিবারের দায়িত্বও কাঁধে নিতে হয়। অনেকে আছে গুরুতর ব্যক্তিগত সমস্যার মধ্যে থাকে, যা পরিবার বা বন্ধুদের কাছে বলতে পারে না। কেউ কেউ আছে সামগ্রিক একাডেমিক অভিজ্ঞতায় সন্তুষ্ট না। কারো কারো স্বাস্থ্যগত সমস্যা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই তাদের ক্যারিয়ার এবং স্বপ্ন পূরণের জন্য উপযুক্ত চাকরি পাবে কিনা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই দুশ্চিন্তাগুলো কিছু শিক্ষার্থীকে সবসময় আঁকড়ে ধরে রাখে। যা তাদের অগ্রগতির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের কি ক্যারিয়ার/মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সিলিংয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়? একজন কাউন্সিলর, যার কাছে একজন শিক্ষার্থী তার সব ধরনের সমস্যার কথা মন খুলে বলতে পারে এবং সমাধান পেতে পারে, সে যেন ঐ শিক্ষার্থীর জীবনে এক আশীর্বাদ। শিক্ষার্থীদের সমস্যা সম্পর্কে সুপ্রশিক্ষিত, ধৈর্যশীল, পর্যবেক্ষক, শিক্ষার্থীর কথা শুনতে আগ্রহী এবং সহানুভূতিশীল একজন কাউন্সিলর শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একজন পথপ্রদর্শক হতে পারেন, যেমনটা শিক্ষকরাও হতে পারেন না।
একজন শিক্ষার্থী একজন শিক্ষককে পায় মাত্র একটি বা দুটি কোর্সে। কোর্স শেষ হওয়ার পর সেই শিক্ষকের সঙ্গে তাদের আর তেমন বেশি যোগাযোগ করার সুযোগ থাকে না। তবে একজন কাউন্সিলরের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা তাদের পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ধরে যোগাযোগ রাখতে পারে। চাইলে এরপরও তারা যোগাযোগ রাখতে পারে। বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীর কাউন্সিলর থাকবে বলেই ধরা হয়। কাউন্সিলরের ভূমিকা তাদের সংস্কৃতিতে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে এর উপস্থিতি সব জায়গাতেই রয়েছে। তারপরও আমরা কাউন্সিলরের ভূমিকা উপেক্ষা করে চলেছি। কেন? এখানে বড় ভূমিকা পালন করার সময় এসেছে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের। সময় এসেছে আত্মবিশ্বাসী ভবিষ্যতের জন্য ‘পেশাদার সহায়তা’র কথা চিন্তা করার।
একজন কাউন্সিলর শুধু শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত সমস্যাই নয়, একাডেমিক প্রোগ্রামের বিষয়েও সহায়তা করতে পারেন। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ চিন্তা করে একাডেমিক প্রোগ্রাম নির্বাচন করার বিষয়ে মোটেই অভিজ্ঞ নয়, কিংবা খুব সামান্য অভিজ্ঞ। অনেকে শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী বা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি প্রোগ্রাম নির্বাচন করে। প্রোগ্রামটির জটিলতা বা সম্ভাবনা সম্পর্কে সে জানে না এবং জানতেও চায় না। ফলে অনেকে প্রচুর একাডেমিক চাপের মধ্যে পড়ে যায়। কখনো কখনো শিক্ষার্থীরা ট্রেন্ড অনুসরণ করে কোনো একটি প্রোগ্রাম নির্বাচন করে ফেলে। যা আরও বেশি ক্ষতিকর।
উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি হারে এমবিএ বা সিএসই নির্বাচন করে। কারণ, এটা ট্রেন্ড। একজন প্রশিক্ষিত কাউন্সিলর শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে তার সার্বিক দিক বিবেচনা করে একটি প্রোগ্রাম নির্বাচনে সহায়তা করতে পারে। তাকে প্রোগ্রামের সার্বিক দিক সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে। যাতে করে প্রোগ্রামের জটিল দিক বা এই প্রোগ্রাম তার ভবিষ্যৎ জীবনে কতটা সহায়ক হতে পারে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে পারে ওই শিক্ষার্থী। এতে করে এটাও নিশ্চিত হবে যে, একজন শিক্ষার্থী ভুল পথে যাবে না এবং পড়াশুনার চাপে মাঝ পথে পড়ালেখা ছেড়ে দেবে না। একজন ভালো কাউন্সিলর শিক্ষার্থীদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে এবং সে অনুযায়ী পথ চলতে সাহায্য করতে পারেন।
সাধারণত বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মেধাবী। সঠিক সুযোগ পেলে তারা তাদের মেধার চমক দেখাতে পারে। আমাদের শিক্ষকদের অনেকেই অত্যন্ত দক্ষ, এটা স্বীকার করতেই হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সংযোগ হয় না এবং এই সমন্বয়ের অভাবে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পড়াশোনায় তাদের মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন। কাউন্সিলিং এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই, আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক ‘প্রশিক্ষিত’ কাউন্সিলর নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।
উচ্চশিক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স অসম্ভব রকম ভালো করতে পারে যে বিষয়গুলো, তার মধ্যে কাউন্সিলর নিয়োগ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষার্থীদের জন্য পেশাদার কাউন্সিলর নিয়োগ দেওয়া উচিত। আর এটা শুধু উচ্চশিক্ষায় নয়, শিক্ষার প্রতিটি স্তরেই। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা নিরূপণে আরও বেশি গবেষণা করা দরকার। যে সমস্যা মোকাবিলায় কাউন্সিলরদের অবশ্যই প্রশিক্ষিত হতে হবে। কাউন্সিলরদের পরামর্শ শিক্ষার্থীদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে তা নিরূপণ করার জন্যও নিয়মিত গবেষণা হওয়া উচিত। পেশাদার কাউন্সিলরদের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় পরিবর্তন আনার পাশাপাশি একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক ফলাফলের উল্লেখযোগ্য উন্নতি করা উচিত। দেশ গঠনে প্রয়োজনীয় মানব সম্পদের ভিত্তি গড়ে তুলতে এর প্রভাব অবশ্যই দৃশ্যমান হবে।
অতনু সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করছেন। ড. আন্দালিব পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। ড. আন্দালিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অনুষদের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এই নিবন্ধটি তৈরি করেন এবং অপ-এডের জন্য উপস্থাপন করেন। অপ-এডগুলো লেখা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ওপর আলোকপাতের মাধ্যমে এবং একে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে। ‘একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রকল্প’তে অবদান রাখতে ইচ্ছুক যে কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ড. আন্দালিবের সঙ্গে [email protected] মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments