কুহেলিয়ার কান্না

মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাওয়ার পথ তৈরি করতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সাড়ে সাত কিলোমিটার নদী ভরাট করে এ সড়ক নির্মাণ করছে। ছবি: মোস্তফা ইউসুফ

মাত্র বছর পাঁচেক আগেও মহেশখালী উপজেলার কুহেলিয়া নদী ছিল প্রাণবৈচিত্রে ভরপুর একটি জীবন্তসত্তা। শুধুমাত্র একটি সড়কের জন্য জায়গা করে দিতে নদী আজ প্রায় বিলীন হওয়ার পথে।

নদীর পূর্ব অংশ থেকে তোলা বালি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে নদীর পশ্চিম অংশ। প্রায় দুই কিলোমিটার ভরাট করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে নদীর অস্তিত্ব। আরও সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার এভাবে ভরাট করে তৈরি করা হবে চার লেনের সড়ক।

মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাওয়ার পথ তৈরি করতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সাড়ে সাত কিলোমিটার নদী ভরাট করে এ সড়ক নির্মাণ করছে। অথচ নদীটির দৈর্ঘ্য মাত্র ১২ কিলোমিটার।

ক্রমাগত ভরাট করার কারণে নদীর বুকে জমেছে পলি ও চর। তাতে আটকে যাচ্ছে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক নৌকা। নদী সংকুচিত হয়ে পরিণত হয়েছে একটি মৃত প্রায় খালে। থেমে গেছে নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নৌ-যোগাযোগও।

কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া থেকে শুরু হয়ে নদীটি মহেশখালীর মাতারবাড়ি হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। মাতারবাড়ি, কালামারছড়াও ধলঘাট— এ তিন ইউনিয়নের জীবন-জীবিকার সঙ্গে মিশে আছে এ নদী।

হাজারো লবণ চাষি ও চিংড়ি ব্যবসায়ী এ নদী দিয়ে তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে যেতেন চট্টগ্রামসহ দেশের নানা স্থানে। সবচেয়ে বড় বিষয়— এ নদী প্রায় তিন হাজার জেলের জীবিকার মূল উৎস ছিল।

মাতারবাড়ি চার নম্বরের ওয়ার্ডের মোহন জলদাশ তাদেরই একজন। তিনি এই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘প্রতিদিন ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় হত আমার এ নদীতে মাছ ধরে। সেই টাকা দিয়ে আমার চার সদস্যের পরিবারের ভালো মতো চলে যেত। রাস্তা বানানোর জন্য যখন থেকে এ নদী ভরাট শুরু হয়, তখন থেকে ধীরে ধীরে নদীর আয়তন কমতে শুরু করেছে। এখন তো নদী প্রায় মরে গেছে বলা চলে।’

গত ১১ জানুয়ারি সরেজমিনে দেখা গেছে, কুহেলিয়া নদীর ব্রিজঘাট এলাকায় ডাম্পার ট্রাক, পে লোডারদিয়ে নদীর ভরাটের দৃশ্য। সেদিন বিশাল বিশাল লোহার পাত নদীর বুকে দিয়ে জিও টেক্সটাইল ব্যাগ দিয়ে নদী ভরাট করা হচ্ছিল।

মাতারবাড়ি ইউনিয়নের ব্রিজঘাট এলাকা থেকে নদীর পূর্ব পাশে প্রায় দুই কিলোমিটারের বেশি নদী ভরাট করে ফেলা হয়েছে।

কুহেলিয়া নদী রক্ষা কমিটির আহবায়ক আবুল বাশার পারভেজ ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘এ নদীর ওপর লবণ চাষি, চিংড়ি চাষি ও জেলেরা নির্ভরশীল ছিলেন। এখন সব শেষ হয়ে গেছে।’

‘আমরা প্রতিবাদ করেছি, মানববন্ধন করেছি, যাতে কর্তৃপক্ষ এমন না করে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি,’ যোগ করেন তিনি।

এ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শ্যামল ভট্টাচার্য দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, বদরখালি থেকে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য ১৩ কিলোমিটারের একটি রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। এর মধ্যে সাড়ে সাত কিলোমিটার রাস্তা কুহেলিয়া নদীর তীর ধরে হবে।’

তার দাবি, কুহেলিয়াকে নদী বলা যাবে না। এটা অনেকটা খালের মতো। তারপরও কুহেলিয়ার যত কম ক্ষতি করা যায় সেদিকে তারা নজর রাখছেন।

প্রকল্প ব্যবস্থাপক সাফখাত হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘এ সংক্রান্ত ছাড়পত্র পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পেয়েছি।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার জেলার উপ-পরিচালক নাজমুল হুদার অভিযোগ, ‘নদী ভরাটের তথ্য গোপন করে ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছে।’

তবে, নাজমুল হুদার এ অভিযোগ নাকচ করেছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকল্প ব্যবস্থাপক সাফখাত হাসান।

গত ২০ জানুয়ারি নদীটি পরিদর্শন করেছিলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য শারমিন সোনিয়া মোর্শেদ। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘যেভাবে নদীর বুক চিরে সড়কটি তৈরি করা হচ্ছে তা ভয়াবহ অপরাধ।’

তার মতে, ‘এভাবে নদী ধ্বংস করে কেউ রাস্তা বানাতে পারেন না। পরিবেশ অধিদপ্তর যদি ছাড়পত্র দিয়ে থাকে, তাহলে তারাও একই অপরাধে অপরাধী। সড়কও জনপথ বিভাগ এ প্রকল্পের নকশায় পরিবর্তন আনার পর তা তারা নতুন করে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন নেয়নি।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘সরকার একদিকে নদী ও খাল রক্ষায় যুদ্ধ করছে, অন্যদিকে সরকারেরই একটি সংস্থা নদী ভরাট করে রাস্তা তৈরি করছে। কথায় ও কাজে এমন স্ববিরোধিতা থাকলে পরিবেশ রক্ষা হবে না।’

Comments

The Daily Star  | English

'Frustrated, Yunus hints at quitting'

Frustrated over recent developments, Chief Adviser Prof Muhammad Yunus is considering stepping down, said sources familiar with what went down at the Chief Adviser’s Office and Jamuna yesterday.

5h ago