বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলুর ঢাকা কলেজ অপারেশন
![Mojibur Rahman Dilu Mojibur Rahman Dilu](https://bangla.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/feature/images/mojibur_rahman_dilu.jpg?itok=4KQsWvvG×tamp=1611591199)
প্রয়াত হয়েছেন মঞ্চ, সিনেমা ও টিভি নাটকের একসময়ের দাপুটে অভিনেতা মুজিবুর রহমান দিলু। বিটিভির স্বর্ণযুগে আলোচিত বহু নাটকে অভিনয় করেছেন। একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্বাও তিনি। তাকে নিয়ে ডেইলি স্টারের কাছে স্মৃতিচারণ করেছেন আরেক বীর মুক্তিযোদ্বা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ।
মুজিবুর রহমান দিলুর সঙ্গে খুব ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমার সম্পর্ক ছিল। শুরুতে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। দিলু সদ্য বিয়ে করেছে। ওর থাকার জায়গার দরকার। বিয়ের পর পর নতুন বউকে নিয়ে আমার পল্টনের বাড়িতে এসে উঠে।
তখন পল্টনের আমাদের বাড়িটি ছিল বাংলো ধরনের। পাশেই রাইসুল ইসলাম আসাদের বাড়ি। একটা সময় দিলু ও তার স্ত্রীর সঙ্গে এই বাড়ির সব সদস্যদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। সেসব কথা খুব মনে পড়ছে।
দিলু চমৎকার রান্নাও করতে পারত। সেসব আমাদের বাসায় থাকার সময়ই জেনেছি। তখনতার কত স্মৃতি আছে!
দিলু একটা সময় তার নাটকের দলের রিহার্সলও আমাদের পল্টনের বাসায় করত। আমার মা দিলুকে খুব পছন্দ করতেন। আমরা সবাই তাকে ভালোবাসতাম।
আমি ছিলাম মুক্তিযুদ্বের সময়ে কমান্ডার। তার সিনিয়র ছিলাম। সেও মুক্তিযোদ্বা ছিল। আমাকে খুব মান্য করত। খুব সম্মান করত। অত্যন্ত বিনয়ী ছিল সে। একাত্তরে দিলু অসীম সাহস নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। আমাদের ঢাকা উওর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্বা হিসেবে দুঃসাহসী অভিযানে অংশ নিয়েছিল। ভীষণ সাহসী না হলে তা পারত না।
দিলু তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নির্দেশে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে জোর করে ক্লাস শুরু করানো হলে, আমরা সিদ্বান্ত নিই, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস চলবে-সেখানে সেখানে আক্রমণ করে ক্লাস বন্ধ করে দেবো। তখন মোট ১৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আক্রমণের পরিকল্পনা নিই। একটা বড় দায়িত্ব পড়ে দিলুর ওপর। ঢাকা কলেজে অপারেশনের দায়িত্ব পায় সে।
সেটা ছিল অক্টোবর মাস। দিন দুপুরে দিলু একটি মাত্র গ্রেনেড নিয়ে ঢোকে ঢাকা কলেজে। অসীম সাহস নিয়ে কলেজে ঢুকে অপারেশন সফল করে জীবিত ফিরে এসেছিল। অপারেশন চালাতে গিয়ে গ্রেনেড নিয়ে মারা যেতে পারত। কিন্তু ফিরে এসেছিল বিজয়ীর বেশে। কতটা সাহস থাকলে এমন অপারেশন করা যায় তা আমরা গেরিলা যোদ্বারা জানি।
সেই ১৩টি অপারেশন সফল হওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মুক্তিযোদ্বা হিসেবে এখানে দিলুর অনেক বড় ভূমিকা ছিল। ভীষণ সাহসী না হলে ওইরকম অপারেশন কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। যারা মুক্তিযুদ্বে অংশ নিয়েছিলেন তারা সবাই সাহসী ছিলেন। কিন্তু কেউ কেউ অনেক বেশি সাহসী ছিলেন। গেরিলা অপারেশন চালানোর মতো বড় সাহস করেছিল দিলু।
এজন্যই দিলুর অবদান ভুলবার নয়। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্বের পর নবনাট্যচর্চায় এক অপরিহার্য মানুষ হয়ে দাঁড়ায় সে। এখানেও নিবেদিত প্রাণ ছিল। নিজেও খুব সুন্দর অভিনয় করত। ঢাকার মঞ্চে ‘আমি গাধা বলছি’ নাটকটিতে অভিনয় করে দিলু ভীষণ নাম করেছিল। নাটকটি তার জন্যই অনেকবার দেখেছি। এই নাটকটি একটি বিদেশি গল্প থেকে নাট্যরূপও সে দিয়েছিল। অভিনয়কে দিলু মেথড এর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল ‘আমি গাধা বলছি’ নাটকটি করে। মঞ্চে তার বেশ কিছু কাজ দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। মন প্রাণ উজার করে অভিনয় করত।
টেলিভিশন নাটকের কথায় আসা যাক। বিটিভিতে ‘লাল মাটির কালো ধোঁয়া’ নামে একটি ধারাবাহিক নাটক প্রযোজনা করেছিলাম অনেক বছর আগে। সেই নাটকে অনেক শিল্পী অভিনয় করেছিলেন। দিলুও অভিনয় করেছিল। সেলিম আল দীন এর লেখা ছিল নাটকটি। তখনই বুঝেছিলাম তার অভিনয়ের প্রতিভার দিকটি। এরপর আমার প্রযোজনায় আরও কয়েকটি নাটকে সে অভিনয় করেছিল।
একজন মুক্তিযোদ্বা হিসেবে জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী ছিল দিলু। শিল্পকে ভালোবেসে সারাজীবন এই চেতনা ধরে রেখে কাজ করে গেছে।
অভিনয় ছাড়া অনেকদিন দিলু হোটেল পূর্বাণীতে ভালো একটি পদে চাকরি করেছে। একসময় দুবাইয়ে তার পোস্টিং ছিল। আবার দেশেও পোস্টিং হয়েছিল একটা সময়ে। একদিকে চাকরি-আরেকদিকে অভিনয়, কোনটিই মিস করেনি। পেশাদারিতে শতভাগ সময় দিয়েও নাটকেও শতভাগ সময় ও ভালোবাসা বিলিয়ে দিয়েছে। এটা সবাই পারে না।
আশির দশকে দিলু একটি বড় কাজ করে। টোনাটুনি নামে শিশু সংগঠন করে। বেশ আলোচনায় আসে টোনাটুনি করে। টোনাটুনির ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকায় একটি বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। ভারত থেকে অনেক বড় বড় অতিথিরা এসেছিলেন।
মুলত বাঙালী সংস্কৃতিকে ভালোবেসে, বাঙালী সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য থেকে কাজ করে গেছে দিলু। এটাই সবচেয়ে বড় কথা। আরেকটি বড় কথা হচ্ছে—দিলু সারাজীবন সততার সঙ্গে কাজ করে গেছে। সততা ধরে রাখা কঠিন। দিলু পেরেছিল। তার অভিনয়, তার যেকোনো উপস্থিতি মিস করব আমরা সবাই।
দিলু ঢাকা ড্রামা করেছিল। একসময় তা ছেড়ে দিল। হয়ত অভিমান ছিল। এসএস সোলায়মানের নাটকের দলে নিয়মিত কাজ করত। দিলুর একটা বিষয় ছিল-পাঁচটা মানে তার কাছে পাঁচটাই। মঞ্চে এমনই ছিল তার কমিটমেন্ট। যেকোনো কাজেই সব সময় এটা ধরে রেখেছিল সে। শত ব্যস্ততার মাঝেও মতিঝিলে অফিস শেষ করে ঠিক সময়ে মগবাজারে নাটকের দলের অফিসে উপস্থিত হতো।
এদেশের যে কোনো নাট্য আন্দোলনে দিলুর সরব উপস্থিতি ছিল। মুক্তিযোদ্বা হিসেবে তার সাহসও ছিল। কখনো কোনো কাজে ভয় পেত না। নাটককে মন থেকে ভালোবেসেছিল। তাই তো সবরকম নাট্য আন্দোলনে এগিয়ে আসত।
অনেক ভালো ভালো নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করেছিল দিলু। কিন্তু ‘সংশপ্তক’ নাটকের মালু চরিত্রটি ছিল তার অভিনয় জীবনের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট। মালু চরিত্রে অভিনয় করে অনেকের কাছে মালু নামে পরিচিতি পেয়েছিল। এইরকম সৌভাগ্য সবার হয় না। ‘আগামী’ সিনেমায় তার নিখুঁত অভিনয় আমি দেখেছি। অসাধারণ অভিনয় করেছিল। তার সাথে পীযূষ বন্দোপাধ্যায় অভিনয় করেছিল, আলী যাকের অভিনয় করেছিল। আজ আলী যাকের নেই, দিলুও নেই।
কিন্ত দিলু থাকবে আমাদের সকলের হৃদয়ে। দিলু থাকবে টিভি নাটকে, মঞ্চে, আমাদের ভালোবাসা থাকবে তার প্রতি সব সময়।
দিলু একজন সাংস্কৃতিক যোদ্বা এবং ১৯৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্বা। মুক্তিযোদ্বা দিলুর জন্য আমার ভালোবাসা চিরকাল থাকবে।
Comments