জার্মানির বৈচিত্র্যময় সব রান্নাঘর
জার্মানিতে ইউনিভার্সিটির ডরমলাইফের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় হলো রান্নাঘর। প্রায় প্রতিটা ইউনিভার্সিটিতে আমাদের সবার রান্নাঘর থাকে। সেখানে প্রত্যেকের মসলা রাখার আলাদা আলাদা চেম্বার থাকে রুম নাম্বার দিয়ে। আমাদের হোয়েনহেইম ইউনিভার্সিটিতে জার্মান আধিক্য বেশি ছিল কিন্তু ইউনিভার্সিটি স্টুটগার্ট, টিউ কেমনিটজ এইসব ইউনিভার্সিটিগুলোতে এশিয়ান শিক্ষার্থী অনেক বেশি। আমার মনে হয় পৃথিবীর সব ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে চাইনিজ আর ভারতীয় বেশি থাকবেই।
আমার ইউনিভার্সিটি স্টুটগার্টের আলমান্ড্রিং ক্যাম্পাসে অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছিল। চারদিকে আওয়াজ সারাক্ষণ গমগম করে কেমন দেশিদেশি ভাব। বাসস্টপ, লাইব্রেরি, রান্নাঘর সব জায়গা থেকেই হিন্দি, উর্দু আর চাইনিজ ভেসে আসে, মাঝরাতেও এদের রান্নাবাড়া চলে। এইসব শব্দ আমার খুব ভালো লাগে কেননা আমাদের হোয়েনহেইম এতোই নিশ্চুপ ছিল যে রবিবার সকালে ঘুম ভাঙলে মনে হতো এখানে আমি ছাড়া কি আর কেউ বেঁচে আছে? এতো নিশ্চুপ সকাল আর রাতগুলো আমার ডরমিটরি আবার ছিল শহর থেকে অনেক দূরে একটা কবরস্থানের পাশে। প্রথম বাংলাদেশ থেকে এসে এরকম নিশ্চুপ নিশুতি এলাকায় মনটা খুব খারাপ থাকতো।
এজন্য শহরের মাঝখানে ইউনিভার্সিটি স্টুটগার্টের আলমান্ড্রিং ক্যাম্পাসের সময়গুলো আমার খুব বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছিল! যাই হোক সেদিন জানুয়ারিতে কোন এক শীতের সকাল, ভীষণ ঠান্ডা আর স্নো এর ভেতর দেখলাম কয়েকজন ভারতীয় তুষার হাতে মাঝরাতেও মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, কিছুটা ফিল্মি স্টাইলে। ছবি তোলার জন্য এরা খুব কষ্ট সহ্য করে। সেই দেখে আমি খুব হাসাহাসি করেছিলাম, কিন্তু টিউ কেমনিটজ এর বাঙালি ছাত্ররাও দেখলাম কম যায় না। এরাও দেখলাম মাইনাস ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় নিজের গায়ে বরফ ছুড়ে ভিডিও বানাচ্ছে।
চাইনিজরা প্রচুর নুডুলস রান্না করে। এরা যে কোন রান্নায় প্রচুর সয়াসস দেয় পুরো রান্নাঘর দুদিন ধরে চিটচিট করে। এদের সত্যিকার চাইনিজ রান্নার গন্ধ খুব একটা ভালো লাগেনি।
শুধুমাত্র ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমারের ছেলেমেয়েরা আমাদের মতো ভাত খায়। এরা কেউ কেউ তিন বেলাই ভাত খায়। আর বিরিয়ানির সুগন্ধ বলে দেয় পাকিস্তানি কেউ বিরিয়ানি রান্না করছে। অন্যদিকে ভারতীয় খাবারে অনেক রকম মসলা থাকে, দেখতে যেমন সুন্দর গন্ধও দারুণ। চাইনিজ, বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানী, ইন্দোনেশীয় এবং আফ্রিকানরা প্রচুর তেলে ডুবিয়ে ভাজাভুজি করে।
তবে ইউরোপিয়ানরা বেশ স্বাস্থ্যসচেতন বলে তেলে ডুবিয়ে ভাজা খাবার এড়িয়ে চলে। বাংলাদেশে ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবির যে লাইফ স্টাইলের কথা বলেন, তেল কম, বাটার, ঘি বা অলিভ ওয়েলের রান্না, রাতে আগে ঘুমিয়ে সকালে তাড়াতাড়ি ওঠা, প্রচুর এক্সারসাইজ করা এসব এখানে এসে দেখেছি। তাদের রান্নার পাশাপাশি ওভেন এর ব্যবহার অনেক বেশি, ওভেনে মাছ মাংস, পিৎজা, লা-জানিয়া রান্না চলে। ইউরোপিয়ানদের খাবারে প্রতিবেলা ফ্রেশ সালাদ বা একটা ফল থাকবেই, বিশেষ করে রাতের খাবারে সালাদ। সালাদের এতো বৈচিত্র্যময়তা কেবল জার্মানদেরই দেখেছি। কেননা এরা খুব স্বাস্থ্য সচেতন আর কিছু তেল যেমন অলিভ ওয়েল সরিষার তেল এরা রান্নার চেয়ে সালাদে পছন্দ করে।
আমাদের ইউনিভার্সিটিতে অর্গানিক এগ্রিকালচার বিভাগের ছেলেমেয়েরা খাবার নিয়ে পড়াশোনা করে এতো খাবার সচেতন যে, দেখা যায় বারবিকিউ পার্টিতেও এরা বাড়ি থেকে অর্গানিক নিয়ে যায়। জার্মানদের রান্নার সময় বা খাবারে তেমন কোন গন্ধ নেই, আবার আমাদের দেশের মতো তেমন রংও নেই আবার খুব কম সময়ে রান্না করে। অল্প একটু নেড়ে নামিয়ে নেয়। আমাদের মতো হলুদ মরিচ দিয়ে কষিয়ে ভুনা করে রান্না নেই।
মধ্যপ্রাচ্যের যারা তারাও আমাদের এশিয়ানদের মতো খুব তেলেভাজা খাবার, কাবাব আর প্রচুর মাংস খায়। জার্মানির বেশিরভাগ কাবাব শপগুলো আরব বা টার্কিশদের।
আর যদি কোনদিন কোন আফ্রিকান ডরমে শুটকি মাছের গুড়ো রান্না করে তাহলে তার গন্ধই জানান দেয় কী রান্না হচ্ছে। এরা সুজি, ক্যাসাভো এই সব দিয়ে সিদ্ধ আটা মাখার মতো কিছু একটা বানায় যেটা এই শুটকি গুড়ো দিয়ে ভাতের মতো খায়। শুয়ো পোকার শুটকি তাদের খুব প্রিয়। খেতে বললে আমি ভীষণ বিপদে পড়ে যাই। আমাকে অনেকবার বলেছে, তবে সাহসে কুলোয়নি।
একদিন ভারতের এক শিক্ষার্থী আমাদের রান্নাঘরে রান্না করছিল। একই চাকু দিয়ে ফ্রোজেন মুরগি আর আম চপিং বোর্ডে কাটছে। সেখান থেকেই আম তুলে মুখে দিচ্ছে আবার মুরগি কাটছে। মা বাঙালি তাই ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকেও বললো, “আম খাবে?”
খুব বিনয়ের সাথে বললাম, ‘না, না ঠিক আছে তুমি খাও। ধন্যবাদ’।
রাতে দেখি সেই ছেলে বাথরুমের দিকে খালি পায়ে পানির বোতল হাতে দৌড়াচ্ছে। সেই দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া কঠিন!
লেখক: রাশা বিনতে মহিউদ্দীন আলমান্ড্রিং, শিক্ষার্থী, স্টুটগার্ট ইউনিভার্সিটি।
Comments