সুন্দরবনে শিকারি চক্রের দৌরাত্ম্য উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন শিকারি চক্রের সদস্যরা। একের পর এক নিধন করা হচ্ছে বন্যপ্রাণী। ফাঁদ পেতে, বিষটোপ দিয়ে এবং গুলি করে বাঘ ও হরিণ হত্যা করা হচ্ছে। এসব বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার রোধে তাৎক্ষণিক শাস্তিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে ১৯টি হরিণের চামড়াসহ দুজনকে আটক করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন শিকারি চক্রের সদস্যরা। একের পর এক নিধন করা হচ্ছে বন্যপ্রাণী। ফাঁদ পেতে, বিষটোপ দিয়ে এবং গুলি করে বাঘ ও হরিণ হত্যা করা হচ্ছে। এসব বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার রোধে তাৎক্ষণিক শাস্তিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে অনেক আগে থেকেই চোরা শিকারি ও পাচারকারী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কেউ কেউ আবার বংশ পরম্পরা সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী শিকার করে চলেছেন। এখন তাদের প্রধান লক্ষ্য বাঘ ও চিত্রা হরিণ। শিকারি চক্র চোরাপথে সুন্দরবনে প্রবেশ করে বাঘ-হরিণ হত্যা করছে। তারা বনের মধ্যে হরিণ জবাই করে মাংস বানিয়ে লোকালয়ে এনে কেজি দরে বিক্রি করে। আর বাঘ ও হরিণের চামড়া লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিক্রি চলে।

সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে শিকারি চক্রের দৌরাত্ম্য উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বনসংলগ্ন গ্রামবাসী বলছেন, শিকারিদের গডফাদার রয়েছে। কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলে। শিকারিরা অনেক সময় জেলের বেশ ধারণ করে সুন্দরবনে প্রবেশ করেছেন। বনজসম্পদ রক্ষা করতে হলে এখনই এদের চিহ্নিত করে দমন করতে হবে।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, পুলিশ, র‌্যাব, কোস্টগার্ড এবং সুন্দরবন বিভাগ ১৯ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই সপ্তাহের আলাদা অভিযানে বন থেকে শিকার করা ১১১ কেজি হরিণের মাংস, ১৯টি হরিণের চামড়া ও একটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করেছে। এসময় শিকারি ও পাচারকারী চক্রের নয় সদস্যকে আটক করা হয়। তবে সবাই ধরা না পড়ায় জানার উপায় নেই সুন্দরবনে কী পরিমাণ বন্যপ্রাণী নিধন করা হচ্ছে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে স্থলভাগের পরিমাণ চার হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার এবং জলভাগের পরিমাণ এক হাজার ৮৭৩ বর্গকিলোমিটার। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। সর্বশেষ জরিপ অনুসারে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ রয়েছে। আর হরিণের সংখ্যা দেড় লাখ।

স্থানীয় সূত্র বলছে, সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে সহজলভ্য হওয়ায় মানুষের কাছে হরিণের মাংস বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। যেখানে গরুর মাংস প্রতি কেজি ৫৫০ এবং খাসির মাংস ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়, সেখানে হরিণের মাংস ৫০০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যায় বলে প্রচার আছে।

সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণ শিকারি চক্র যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানায় বনসংলগ্ন গ্রামবাসী।

পুলিশ, কোস্টগার্ড ও বন বিভাগের তথ্য মতে, ২ ফেব্রুয়ারি ভোরে বাগেরহাট গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ রামপাল উপজেলার বগুড়া নদীর চর থেকে ৪২ কেজি হরিণের মাংসসহ শিকারি চক্রের সদস্য বাবা ও ছেলেকে আটক করে।

এর আগে, ২৯ জানুয়ারি রাতে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের সদস্যরা মোংলা উপজেলার দিগরাজ বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪৭ কেজি হরিণের মাংস এবং একটি মাথাসহ তিনজন হরিণ শিকারি ও পাচারকারীকে আটক করে। ৩০ জানুয়ারি রাতে বন বিভাগ শরণখোলা থেকে ২২ কেজি হরিণের মাংসসহ এক শিকারিকে আটক করে।

২৩ জানুয়ারি ভোরে জেলা ডিবি পুলিশ শরণখোলা উপজেলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৯টি হরিণের চামড়াসহ হরিণ শিকারি ও পাচারকারী সিন্ডিকেটের দুজনকে আটক করে।

এ ছাড়া, ১৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সুন্দরবন বিভাগ ও র‌্যাব যৌথ অভিযান চালিয়ে শরণখোলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি বাঘের চামড়াসহ বাঘ শিকারি চক্রের সদস্য গাউস ফকিরকে আটক করে।

শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন চাল রায়েন্দা গ্রামের সঞ্জয় কুলু জানান, মাঝে মধ্যে হরিণ ও বাঘ শিকারিরা ধরা পড়ছেন। কিন্তু এদের যারা পরিচালনা করেন সেই গডফাদাররা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। আর যারা ধরা পড়ছেন তারা দুর্বল আইনের কারণে কয়েক দিন পর জেল থেকে ফিরে এসে বন্যপ্রাণী শিকারে লিপ্ত হয়। এভাবেই চলছে সুন্দরবনে বাঘ-হরিণ শিকার।

মোংলা উপজেলার বুড়বুড়ি গ্রামের সবিজ খান বলেন, ‘বনসংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে চোরা শিকারি চক্র গড়ে উঠেছে। তারা বনে প্রবেশ করে বাঘ ও হরিণ হত্যা করে চলেছে। বন সংলগ্ন গ্রামে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে হরিণের মাংস বিক্রি হয়। সুন্দরবন হচ্ছে আমাদের মায়ের মতো। সবার দায়িত্ব হবে সুন্দরবন এবং বনের সম্পদ রক্ষা করা।’

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, হঠাৎ করে সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের অপতৎপরতা বেড়েছে। শিকারি চক্র বংশ পরম্পরায় সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী শিকার করে আসছে।

তিনি বলেন, ‘শিকারিদের মন-মানসিকতা পরিবর্তন না হলে বন্যপ্রাণী শিকার বন্ধ করা কঠিন হবে। এজন্য শিকারিদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। একইসঙ্গে বন সংলগ্ন বাসিন্দাদের সচেতন হতে হবে এবং বনের সম্পদ রক্ষায় তাদের এগিয়ে আসতে হবে।’

বেলায়েত হোসেন জানান, চোরা শিকারিদের তৎপরতা রোধ করতে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের ৩৩টি টহল ফাঁড়ি এবং সাতটি স্টেশনকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। স্মার্ট পেট্রোলসহ বিভিন্ন ধরনের টহল কঠিনভাবে জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু জনবল এবং জলযানের সংকট রয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, ১৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সুন্দরবন সুরক্ষা’ নামে চার বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। আগামী ১ জুলাই থেকে এই প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হলে অনেক সংকট কাটানো সম্ভব হবে।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ওয়াইল্ড টিমের প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘করোনায় মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়েছে। সচ্ছল মানুষগুলো শিকারিদের অনেকটা উৎসাহিত করছেন। যেসব ভোক্তা হরিণের মাংস ক্রয় করছেন শিকারিদের মতো তারাও সমান অপরাধী। সুন্দরবনের বাঘ ও হরিণ শিকার রোধ করতে বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করত হবে। একইসঙ্গে বন সংলগ্ন গ্রামবাসীকে বনের সম্পদ রক্ষায় সম্পৃক্ত করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘মাঝে মধ্যে বাঘ ও হরিণ শিকারিদের ধড়া পড়ার খবর মানুষ জানতে পারে। কিন্তু মানুষ আইনের প্রয়োগ জানতে পারে না।’

অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীদের তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তির আওতায় আনা গেলে সুন্দরবন কেন্দ্রিক অপরাধ প্রবণতা কমবে বলে তিনি মনে করেন।

বাগেরহাটের পুলিশ সুপার পঙ্কজ চন্দ্র রায় বলেন, ‘বিগত সাত মাস ধরে সুন্দরবন পার্শ্ববর্তী শরণখোলা, রামপাল, মোংলা এবং মোড়েলগঞ্জ থানা পুলিশ প্রতিদিন সুন্দরবনে অভিযান পরিচালনা করছে। বনের সম্পদ রক্ষা করতে পুলিশ নানাভাবে কাজ করছে। বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। পুলিশের অভিযানে ১০ দিনের ব্যবধানে ৪২ কেজি হরিণের মাংস, ১৯টি হরিণের চামড়া, হরিণ শিকারের এক বস্তা ফাঁদ এবং শিকারি ও পাচারকারী চক্রের চার সদস্যকে আটক করা হয়েছে।’

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago