অপ্রাপ্তি-অসন্তুষ্টি নিয়েই কাজে ফিরলেন আকিজের বিড়ি শ্রমিকরা

ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হোসেনাবাদ বাজার সংলগ্ন কুষ্টিয়া-প্রাগপুর সড়ক অবরোধ করেন। ৯ জানুয়ারি ২০২১। ছবি: স্টার

অনেক অপ্রাপ্তি ও অসন্তুষ্টি নিয়েই কাজে ফিরেছেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে আকিজের দুটি বিড়ি কারখানার প্রায় আট হাজার শ্রমিক। তবে বরখাস্ত হওয়া ১৯ শ্রমিককে আর বহাল করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।

শ্রমিকরা বলছেন, কাজে না ফিরলে তাদের বেঁচে থাকার অন্য কোনো উপায় নেই। আর বিড়ি কারখানার মালিক পক্ষ বলছেন, শ্রমিকদের বেশ কিছু দাবি মেনে নিয়েই তারা কারখানা খুলেছেন।

গত ৯ জানুয়ারি এক শ্রমিক অসন্তোষে বন্ধ হয়ে যায় উপজেলার হোসেনাবাদ ও ফিলিপনগরে অবস্থিত আকিজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আকিজ বিড়ির দুটি কারখানা। কারখানা কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন ও শ্রমিকদের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক ও আলোচনার পর গত ৪ ফেব্রুয়ারি আংশিক ও ৬ ফেব্রুয়ারি পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়েছে কারাখানা।

কারখানা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের কাছ থকে জানা যায়, বিড়ি শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে বেশ কিছু দাবি জানিয়ে আসছে। তার মধ্যে কারখানায় হাজিরার সময় পূনর্নির্ধারণ, কারখানার ভেতরে বিড়ি বাঁধার পরিমাণ বৃদ্ধি করা, একজন শ্রমিকের একাধিক মজুরি বই জটিলতা ও জাতীয় পরিচয় পত্রের বাধ্যবাধকতা শিথিল করা অন্যতম।

কারখানা সূত্র বলছে, শ্রমিকদের কারখানায় প্রবেশের সময় নির্ধারণ করা ছিল সকাল ৭টা।

শ্রমিকদের অভিযোগ, পদ্মা নদীর অনেক দুর্গম চর থেকে এসে অসংখ্য শ্রমিক কাজ করেন এই কারখানায়। অনেক শ্রমিককে পদ্মা পাড়ি দিয়ে, চর পাড়ি দিয়ে, প্রায় ১২ থেকে ১৪ কিলোমিটার পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে, স্থানীয় ইঞ্জিন চালিত পরিবহন দিয়ে, এমনকি পায়ে হেঁটে কারখানায় আসতে হয়। অনেক সময়, বিশেষত শীত এবং বর্ষা মৌসুমে তারা সময়মতো কারখানায় পৌঁছাতে পারেন না। নির্ধারিত সময়ের পর কারখানা কর্তৃপক্ষের কড়াকড়িতে অনেক সময় শ্রমিকদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে মজুরি কেটে রাখার ঘটনাও ঘটে। শ্রমিকরা কারাখানায় প্রবেশের সময় সকাল ৭টা থেকে বাড়িয়ে ৮টা করার অনুরোধ জানিয়ে আসছিল। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের নির্ধারিত সময় পরিবর্তন করতে অনড় ছিল।

গত ৯ জানুয়ারি বেশ কয়েকজন শ্রমিক সময়মতো কারাখানায় উপস্থিত হতে না পারলে তাদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এ সময় কারখানার নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে কারখানা কর্তৃপক্ষ দৌলতপুর থানায় খবর দেন।

পুলিশ গিয়ে শ্রমিকদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। শ্রমিক-পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হোসেনাবাদ বাজার সংলগ্ন কুষ্টিয়া-প্রাগপুর সড়ক অবরোধ করেন। ওইদিন দুপুর পর্যন্ত উপজেলার প্রধান এই সড়কটি টায়ার জ্বালিয়ে ও গাছের গুড়ি ফেলে অবরোধ করে রাখা হয়। হোসেনাবাদে এসে আন্দোলনে যোগ দেন ফিলিপনগরে অবস্থিত আকিজের বিড়ি কারখানার শ্রমিকরাও। দুই কারাখানার শ্রমিকরা একজোট হয়ে বিক্ষোভ দেখান।

এ ঘটনার পর বিড়ি কারখানা দুটি বন্ধ ঘোষণা করে আকিজ কর্তৃপক্ষ। কর্মহীন হয়ে পড়েন দুটি কারখানার প্রায় আট হাজার শ্রমিক।

এরপর শ্রমিকদের দাবি ও কারাখানা খোলার ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন, কারখানা মালিকপক্ষ এবং শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে সমঝোতা হয়।

কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সরওয়ার জাহান বাদশাহ কারাখানা খোলার ব্যাপারে প্রতিনিধি পাঠিয়ে সমঝোতার উদ্যোগ নেন।

সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি প্রকৌশলী জিয়াউল কবীর সুমন, কারখানার ম্যানেজার আরিফুর রহমান, দৌলতপুর থানার ওসি তদন্ত শাহাদাৎ হোসেন, উপজেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি এসি ল্যান্ড আজগর আলী এবং শ্রমিকদের একটি প্রতিনিধি দল আলোচনা করে সমঝোতায় আসে।

কারখানার ম্যানেজার আরিফুর রহমান বলেন, ‘শ্রমিকদের কারখানায় প্রবেশের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। কারখানার বাইরে বিড়ির ঠোঙা বানানোর ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়েছে। কারখানার ভেতরে বিড়ি বাঁধার পরিমাণ দিনে ১০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১৪ হাজার করার দাবি ছিল শ্রমিকদের। সেটা করা সম্ভব না। কারণ, এখানে এটা করতে গেলে আকিজের অন্যান্য সব কারখানাতেও এটা করতে হবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিশু শ্রমিক ঠেকাতে সরকারি নির্দেশনা মেনেই কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জাতীয় পরিচয় পত্র বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু শ্রমিকদের এতে আপত্তি রয়েছে, তারা এটি বাতিল চান। এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এতে করে কারখানায় শিশু শ্রমিক ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সবার অনুরোধ মেনে শ্রমিকদের জাতীয় পরিচয় পত্র জমা দেওয়ার সময় তিন মাস বাড়ানো হয়েছে এবং মজুরি বই পুনর্বহাল করা হয়েছে।’

সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি জিয়াউল কবীর সুমন বলেন, ‘অনেক শ্রমিকের ছয় থেকে সাতটা করেও মজুরি বই আছে। এরা নিজেরা বিড়ি বাঁধার কাজ না করে সহকারী দিয়ে বিড়ি বাঁধায় এবং নিজেরা কারখানায় প্রভাব বিস্তার করতো। এ ব্যাপারে মালিকপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, একজনের নামে একাধিক খাতা থাকবে না।’

শ্রমিক নেতা বিপ্লব হোসেন বলেন, ‘অনেক দাবি থাকলেও সেটা দেখার কেউ নেই। বিড়ি কারখানায় শিশু শ্রমিক নিষিদ্ধ করা হয়নি। তবে এ কারখানাতে শিশু শ্রমিক নেই। বরখাস্ত করা শ্রমিকদের চাকরিতে বহাল না করা অন্যায়। কারখানা কর্তৃপক্ষকে এই সিদ্ধান্ত পুনরায় বিবেচনা করার দাবি জানাচ্ছি।’

দৌলতপুর উপজেলার হোসেনাবাদে আকিজের এই বিড়ি কারাখানায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। শ্রমিকদের দাবিকে কেন্দ্র করে প্রায়ই সেখানে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে। শ্রমিকরা কাজ ফেলে রাস্তায় আন্দোলনে নেমে এসেছেন বহুবার। সেখানে সবচেয়ে বড় শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা দেয় ২০১২ সালের ১৫ জুলাই। সেদিন কারখানার নিরাপত্তাকর্মীরা শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। তাদের গুলিতে মিন্টু (২২) ও রাকিবুল (২৫) নামে দুই শ্রমিক নিহত হন।

Comments

The Daily Star  | English

JnU students vow to stay on streets until demands met

Jagannath University (JnU) students tonight declared that they would not leave the streets until their three-point demand is fulfilled

4h ago