পশ্চিমবঙ্গে মমতাই থাকবে না বিজেপি আসবে

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জমে উঠেছে বিধানসভা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, নির্বাচনের তারিখ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির পর জানা যাবে। করোনাভাইরাস মহামারিতে এ বছর নির্বাচন কমিশন রাজ্যটিতে ছয় থেকে সাত দফায় ভোটগ্রহণের পরিকল্পনা করছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকারের মেয়াদ এ বছর ৩০ মে শেষ হতে চলেছে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এর আগে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। তবে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে।
২০১১ ও ২০১৬ সালের নির্বাচনে জিতে টানা দুই মেয়াদে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আছে তৃণমূল কংগ্রেস। এর আগে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া- মার্ক্সিস্ট (সিপিএম) এর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ছিল। এ বছর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেছে বামফ্রন্ট।
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে তৃতীয় মেয়াদে জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী তৃণমূল, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে জিততে সর্ব শক্তি দিয়ে মাঠে নেমেছে বিজেপি।
জয়ের ব্যাপারে ১১০ শতাংশ আত্মবিশ্বাসী মমতা
নির্বাচনের আগে তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতার দলত্যাগের পরেও জয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী মুখ্যমন্ত্রী মমতা। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তৃণমূল নেতা মমতা জানান, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে তিনি ১১০ শতাংশ আত্মবিশ্বাসী। এছাড়াও তার দল কমপক্ষে ২২১টি আসনে জয় পাবে বলে দাবি করে তিনি।
এবারের নির্বাচনে বিজেপিকেই মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখছেন মমতা। সাক্ষাৎকারে বিজেপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'বাংলা (পশ্চিমবঙ্গ) কখনই জাতি কিংবা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দেখেনি। বিজেপিই এটা শুরু করেছে। বিজেপি মানুষের মধ্যে ধর্ম ও জাত ঢুকিয়ে একে অন্যের মধ্যে সংঘর্ষ তৈরি করেছে।'
বাঙালিদের মধ্যেও বিজেপি বিভেদ তৈরি করছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, 'তারা কাউকে বাংলাদেশি আবার কাউকে বিহারি বলে বাঙালিদেরকে বিভক্ত করেছে। ভাষা নিয়েও বিভক্তি তৈরি করা হচ্ছে।'
মমতার দাবি, 'বিজেপি এমন করছে, কারণ উন্নয়নের বিবেচনায় যদি ভোট হয়, তাহলে বিজেপি জানে তারা হেরে যাবে।'
প্রতিদিন তাদের লোকেরা "গুণ্ডামো" করছে বলে অভিযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। আয়কর ও সিবিআই-এর নামে ভয় দেখানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি তৃণমূলকে ধ্বংস করবেন বলেছেন। তিনি (অমিত শাহ) কী ভাবেন? আমি কি তার বন্ডেড শ্রমিক না চাকর?'
এমন ঘৃণ্য রাজনৈতিক দল তিনি দেখেননি বলে মন্তব্য করেছেন মমতা ব্যানার্জি।
এছাড়াও নির্বাচনী প্রচারণায় করোনাভাইরাস মহামারি ও ঘূর্ণিঝড় আম্পানে মোদি সরকারের ব্যর্থতা ও নিজের দলের সাফল্য ও চেষ্টার কথাও উল্লেখ করেন মমতা।
বিজেপি জিতলে সীমান্ত দিয়ে পাখিও ঢুকতে পারবে না: অমিত শাহ
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টিতে জয় পায় বিজেপি। ফলে বিধানসভা নির্বাচনে জয় পেতে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদির দল। বিজেপির প্রধান কৌশলবিদ হিসেবে পরিচিত অমিত শাহ কিছুদিন পরপরই পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসছেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানায়, গত ১১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন না করা পর্যন্ত বিজেপি বিশ্রাম নেবে না।
তিনি বলেন, এই "যুদ্ধ" কেবল মমতাকে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য নয়, রাজ্যটিকে "সোনার বাংলা" হিসেবে গড়ে তোলার জন্যেও।
অমিত শাহ জানান, পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে জয়ের ফলে ওড়িশা, তেলেঙ্গানা এবং দেশের অন্যান্য রাজ্যে যেখানে বিজেপি ক্ষমতায় নেই, সেখানেও নির্বাচনী সাফল্যের পথ প্রশস্ত হবে।
পশ্চিমবঙ্গের ১০ কোটি জনসংখ্যার দুই কোটির কাছে বিজেপির বার্তা ও কেন্দ্রের অর্জন প্রচারণার জন্য পৌঁছানোর জন্য বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া টিমকে অভিনন্দন জানান তিনি।
এদিকে, বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কোচবিহার ও ঠাকুরনগরের দুই জনসভা থেকে অমিত শাহ দাবি করেছেন, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে সীমান্ত দিয়ে 'কোনও মানুষ দূরে থাক - একটা পাখিও ঢুকতে পারবে না।'
জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, 'অনুপ্রবেশ নিয়ে আপনারা বিরক্ত কি না বলুন? আর মমতা ব্যানার্জি কি আদৌ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারবেন? জেনে রাখুন, রাজ্যে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে তবেই কেবল অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে। বিজেপি সরকার গড়লে সীমান্ত দিয়ে মানুষ তো দূরে থাক - একটা পাখিও ঢুকতে পারবে না দেখে নেবেন।'
অমিত শাহের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূল বলছে, অমিত শাহ'র এই বক্তব্য পুরোপুরিই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এমপি মানসরঞ্জন ভুঁইঞা বিবিসি বাংলাকে জানান, 'আন্তর্জাতিক সীমান্ত দেখাশোনার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। বাইরের দেশ থেকে যারা অবৈধভাবে ভারতে ঢুকবেন, তাদের বাধা দেওয়া বা তাদের ওপর নজরদারি করার দায়িত্ব বিএসএফের - যারা কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনী। এখানে অনুপ্রবেশের জন্য মমতা ব্যানার্জির সরকারের দোষ হয় কী করে?'
এছাড়াও গত ১১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের জনসভায় করোনাভাইরাসের টিকাদান শেষ হলেই বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কথিত অনুপ্রবেশ ইস্যুর আড়ালে বিজেপি মূলত সাম্প্রদায়িক এজেন্ডাকেই পুঁজি করে নির্বাচনে জয় পেতে চাইছে।
কংগ্রেসের সঙ্গে জটিলতায় বামফ্রন্ট
কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের সমঝোতা ঠিক থাকলেও, বামফ্রন্টের অন্য দলের মধ্যে জোট নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, বিশেষ করে জোট নীতিমালা নিয়ে আরএসপি ও ফরওয়ার্ড ব্লক নেতৃত্বের সঙ্গে কংগ্রেসের জটিলতা আছে। তবে, সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর ব্যাপারে আশাবাদী সিপিএম ও সিপিআই।
এদিকে, মুখ্যমন্ত্রী মমতার দাবি, তৃণমূলকে হারাতে বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করেই আলাদা নির্বাচন করছে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট। মূলত তৃণমূলের ভোটেই তারা ভাগ বসাবে বলে দাবি করেন তিনি।
তৃণমূল নেতাদের দাবি, বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস যদি সত্যিই বিজেপিবিরোধী শক্তি হয় তবে তাদের তৃণমূলের পেছনে দাঁড়ানো উচিত, কারণ এটিই একমাত্র দল যা বিজেপির বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
তৃণমূলের প্রবীণ নেতা তাপস রায় ইন্ডিয়া টুডেকে তৃণমূলের এ অবস্থানের কথা জানান।
তিন দল এক জোট না কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিদি (মমতা) কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গঠনে আগ্রহী ছিলেন না।
ত্রিমুখী লড়াই
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটের ফলে প্রথমবারের মতো পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অবস্থান শক্তিশালী হয়। ওই নির্বাচনই মূলত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে জয় পেতে ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণায়ও নেমেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। গত লোকসভায় অধিকাংশ মতুয়াদের ভোটই বিজেপিতে চলে যাওয়ায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্ববাদ ও বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশের মতো বিষয় নিয়েই প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী মোদির দল। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি, দার্জিলিং, পুরুলিয়ার মতো জেলাগুলোতে, যেখানে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতেছিল সেখানে বিধানসভা নির্বাচনেও বিপুল ভোট পেতে পারে বিজেপি। এছাড়াও মালদার মতো কয়েকটি জেলাতেও বিজেপির সাফল্যের সম্ভাবনা আছে।
পর্যবেক্ষকদের ধারণা, কলকাতা, বর্ধমানের মতো অঞ্চলগুলোতে তৃণমূলের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকলেও একের পর এক নেতাকর্মীদের দলত্যাগ ও বিজেপিতে যোগদান তৃণমূলের অবস্থান কিছুটা নড়বড়ে করে তুলেছে। তাছাড়া বিজেপি সরকার কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকায় প্রচারণার ক্ষেত্রে তারা বেশ কিছু সুবিধাও পাচ্ছেন।
অন্যদিকে, কংগ্রেস ও দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টেরও সমর্থক- ভোটার আছে। পশ্চিমবঙ্গে যারা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কিংবা বিজেপির হিন্দুত্ববাদ বিরোধী তাদের কেউই বিজেপিতে ভোট দেবে না। এখানে তাদের বিকল্প হলো তৃণমূল কিংবা কংগ্রেস-বামফ্রন্ট জোট। ফলে একটা বড় অংশের ভোট দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
Comments