করোনা টিকাদান: গ্রামাঞ্চলে সাড়া কম

দেশের বিভাগীয়সহ বড় বড় শহরগুলোতে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচির অগ্রগতি বেশ ভালো হলেও গ্রামাঞ্চল ও ছোট শহরগুলোর চিত্র বিপরীত। গ্রামাঞ্চল ও ছোট শহরগুলোর বাসিন্দারা অনলাইন রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াকে ঝামেলাপূর্ণ মনে করায় সেখানে তেমন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না বলে জানান বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য অপেক্ষারত মানুষ। ছবি: আনিসুর রহমান

দেশের বিভাগীয়সহ বড় বড় শহরগুলোতে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচির অগ্রগতি বেশ ভালো হলেও গ্রামাঞ্চল ও ছোট শহরগুলোর চিত্র বিপরীত। গ্রামাঞ্চল ও ছোট শহরগুলোর বাসিন্দারা অনলাইন রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াকে ঝামেলাপূর্ণ মনে করায় সেখানে তেমন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না বলে জানান বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার দসমন্তপুর গ্রামের ৬৮ বছর বয়সী কৃষক জ্যোতিমোহন দাস এখনো গণটিকার বিষয়ে তেমন কিছুই জানেন না।

‘আমি এখানে কাউকে ভ্যাকসিন দিতে দেখছি না। ভ্যাকসিন নিতে হলে যে নিবন্ধন করতে হবে ও সদর উপজেলায় যেতে হবে, আমি তাও জানি না। আমি ভেবেছিলাম তারা যেভাবে এসে শিশুদের টিকা দিয়ে যায়, এবারও তাই দেবে’, বলেন তিনি।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় গ্রামাঞ্চলের মানুষদেরও টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনতে সেসব অঞ্চলে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি জোরদার করা প্রয়োজন।

করোনা মোকাবিলায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিষয়টি এমন নয় যে মানুষের আগ্রহ নেই। কিন্তু, রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। পাশাপাশি প্রচার-প্রচারণা বাড়ালেও আরও অনেক মানুষ ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।’

দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর থেকে গতকাল দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ২২ লাখ মানুষ অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। তাদের মধ্যে ১৩ লাখ ৬০ হাজারের মতো মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।

চলতি মাসের মধ্যেই সম্মুখসারির যোদ্ধা ও ৫৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়স্ক ৬০ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়।

গত ২৭ জানুয়ারি থেকে সরকারি ওয়েবসাইট সুরক্ষায় (www.surokkha.gov.bd) অনলাইন রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

অনলাইন রেজিস্ট্রেশনে কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পাওয়ায় গত ৩ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৬০ লাখ থেকে ৩৫ লাখ রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত শনিবার তা আবার বাড়িয়ে ৭০ লাখ করা হয়।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভ্যাকসিন নেওয়ার ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৪০ করার পর থেকেই টিকাদান কর্মসূচিতে অগগ্রতি পরিলক্ষিত হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইনের সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক মৃধা বলেন, ‘দিনকে দিন মানুষের আগ্রহ বাড়ছে... প্রয়োজন হলে আমরা মাসব্যাপী প্রচারণা চালাব।’

দেশের আট বিভাগের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত সবচেয়ে কম মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে বরিশালে। আর সর্বোচ্চ ঢাকায় প্রায় পৌনে চার লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।

বরিশাল বিভাগের জন্য তিন লাখ ৪৮ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৬৩ হাজার ৬৫৯ ডোজ দেওয়া হয়েছে।

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাসের মতে, বিভাগটিতে কম মানুষকে টিকা দেওয়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে।

‘এখানে মানুষজনের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। এ ছাড়া, বরিশাল বিভাগে যোগাযোগ একটি বড় সমস্যা। পাশাপাশি রেজেস্ট্রশনের সময় ইন্টারনেটের ধীরগতির কারণেও আমরা বাধার মুখে পড়ছি’, বলেন তিনি।

তবে, দিনকে দিন ভ্যাকসিনে নিতে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ‘কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদেরকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দিতে বলাসহ মাঠপর্যায়ে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের আমরা এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছি’, বলেন তিনি।

সিলেটের চারটি জেলার জন্য চার লাখ ৪০ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে সিলেটের জন্য দুই লাখ ২৮ হাজার, সুনামগঞ্জের জন্য ৮৪ হাজার, মৌলভীবাজারের জন্য ৬০ হাজার ও হবিগঞ্জের জন্য ৭২ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হয়েছে।

গতকাল পর্যন্ত সেখানে এক লাখ ছয় হাজারের মতো মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।

সিলেট বিভাগীর স্বাস্থ্য কার্যালয়ের সহাকরী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘প্রথম কয়েক দিন সাড়া খুব কম থাকলেও ধীরে ধীরে তা বাড়ছে। কিন্তু, এখনো সন্তোষজনক নয়।’

‘অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই সাড়া দিচ্ছেন না। আমরা তাদের বোঝাতে তাদের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। যদিও আমাদের সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলমান, তবে, সাধারণ মানুষ সচেতন নয়’, বলেন তিনি।

রাজশাহী বিভাগের স্বাস্থ্যকর্মীরা মানুষকে ভ্যাকসিন কেন্দ্রে আনার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ডেইলি স্টারের রাজশাহী সংবাদদাতা জানিয়েছেন, মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য রাজশাহী বিভগের সংবাদদাতারা আটটি জেলার মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করছেন।

ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহীদের রেজিস্ট্রেশন করতে রাজশাহীর ভ্যাকসিন কেন্দ্রগুলোতে ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সুবিধাও রাখা হয়েছে।

এতকিছুর পরেও জনসাধারণের কাছ থেকে পরিমাণ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, তা সন্তোষজনক নয় বলেই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

রাজশাহী বিভাগে ছয় লাখ ৭২ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত এক লাখ ৫৩ হাজার জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।

রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. আহসান তালুকদার বলেন, ‘টিকাদান কর্মসূচি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে আমরা সার্বিক কার্যক্রম সম্প্রসারণের চেষ্টা করছি। আমার মনে হয় এখানে সংক্রমণের হার কম হওয়ার কারণে লোকজনের মধ্যে ভ্যাকসিন নেওয়ার তেমন আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।’

রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, ‘ভ্যাকসিন নিতে গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলের মানুষ বেশি রেজিস্ট্রেশন করছেন। গ্রামাঞ্চলের মানুষকে ভ্যাকসিন নিতে হলে অনেকটা পথ যাতায়াত করে উপজেলা সদরে আসতে হবে, যা তারা করতে চাচ্ছেন না।’

ময়মনসিংহ বিভাগের জন্যে পাঁচ লাখ চার হাজার ডোজ ভ্যাকসিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত ৬০ হাজার ৬০২ জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।

ময়মনসিংহ বিভাগীর স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. শাহ আলম বলেন, ভ্যাকসিন নিয়ে গুজব রোধে সচেতন করার পর থেকে বেশি সংখ্যক মানুষ ভ্যাকসিন নিতে আসছেন।

খুলনা বিভাগের জন্যে পাঁচ লাখ ৮৮ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত এক লাখ ৫৩ হাজার জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।

রংপুরের জন্য ছয় লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং এক লাখ ২৭ হাজার জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে।

টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীর স্বাস্থ্য পরিচালক এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

(দ্য ডেইলি স্টারের সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, ময়মনসিংহের সংবাদদাতারা এই প্রতিবেদনের জন্য তথ্য দিয়েছেন।)

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

6h ago