উচ্চশিক্ষায় বাংলা: বই সংকট, নীতিতে ধীরগতি

amar_ekushey.jpg
স্টার ফাইল ফটো

উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও মূলত বাংলা পাঠ্যপুস্তক ও পর্যাপ্ত গবেষণা-গ্রন্থের অভাবে এর প্রচলন করা যাচ্ছে না।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনাগ্রহের জন্যই বাংলায় পর্যাপ্ত একাডেমিক এবং রেফারেন্স বই প্রণয়ন করা যায়নি।

কলা, সামাজিক বিজ্ঞানসহ বেশকিছু অনুষদের অধীন বিভিন্ন বিভাগে বাংলা ভাষায় রচিত বা অনূদিত কিছু বই থাকলেও বিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো এবং মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বাংলার ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে।

উদাহরণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়টির বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, ভূগোল ও পরিবেশ এবং প্রকৌশল ও প্রযুক্তি- এই চারটি অনুষদের ১৩টি বিভাগের সিলেবাস ঘেঁটে দেখা গেছে, বিভাগগুলোতে মোট ৩,২০১টি বইয়ের রেফারেন্স দেওয়া হয়। এর মধ্যে বাংলা বইয়ের সংখ্যা মাত্র ৩৪টি।

এই চারটি অনুষদের বাকি ১৬টি বিভাগের সিলেবাস সংগ্রহ করা যায়নি। তবে যেগুলো পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সাতটি বিভাগে কোনো বাংলা বই পড়ানো হয় না।

এর চেয়েও বড় বিষয়, ইংরেজি বইগুলোর লেখকদের মধ্যে ১০৪ জন বাংলা ভাষাভাষী।

অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ থেকে সম্প্রতি স্নাতক শেষ করা শিক্ষার্থী জুয়েল রানা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের ক্লাসে কোনো বাংলা বই পড়ানো হয়নি। আর আমাদের বিষয়ের ওপর তেমন কোনো ভালো বাংলা বই বা অনুবাদ চোখেও পড়েনি।’

তিনি বলেন, ‘ইংরেজিতে দক্ষতা না থাকা অনেক শিক্ষার্থীও হয়তো বিজ্ঞানটা ভালো বুঝে। কিন্তু যখন ভাষাগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠতে পারে না, তখন হতাশ হয়ে যায় এবং পরীক্ষায় খারাপ করতে থাকে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা সংস্থার হিসাবে, ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা সর্বসাকুল্যে বই প্রকাশ করেছে ১৭৪টি, যার মধ্যে বাংলায় মাত্র ৬১টি। এর মধ্যে ২৬টি বই এখন আর পাওয়া যায় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের দেশিয় গবেষকদের বাংলায় বিজ্ঞান, মেডিকেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাঠ্যপুস্তক লিখতে উৎসাহিত করা দরকার। কেননা মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা ছাড়া জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করা যায় না।’

একই অবস্থা মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী নওশীন তাবাসসুম রূপা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চিকিৎসাশাস্ত্রের পড়াশোনায় বাংলার ব্যবহার নেই বললেই চলে।’

উচ্চশিক্ষায় বাংলা বইয়ের সংখ্যা কম, এর কারণ জানতে জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু এ দেশে বাংলা উচ্চশিক্ষার মাধ্যম নয়, তাই এখানে ভালো বই নেই।’

তিনি বলেন, ‘১৯৭৪ সালে প্রণীত কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে ছিল প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা। কিন্তু ওই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি।’

‘এই বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য প্রধান কারণ আমাদের হীনমন্যতা’, বলেন এই শিক্ষাবিদ।

গবেষক ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের মতে, উচ্চশিক্ষায় বাংলা পুরোপুরি চালু না হওয়ার পেছনে বাংলা একাডেমির অবহেলা ছিল।

তিনি বলেন, ‘বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ব্যবহার সহজ করা। তবে প্রতিষ্ঠানটি এটি করতে ব্যর্থ হয়েছে।’

অবশ্য তিনি আশির দশকে পরিভাষা প্রণয়ন কমিটির কার্যক্রমের ভূমিকার প্রশংসা করেন। তবে এ ধরনের কমিটি আর করা হয়নি বলেও আক্ষেপ রয়েছে তার।

এই লেখক মনে করেন, বাংলা একাডেমি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় আন্তরিকভাবে চাইলে এতদিনে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল।

বাংলা একাডেমি আইন-২০১৩ এর ১০ (৩) ও ১০ (৪) অনুচ্ছেদে একাডেমির কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলা ভাষার প্রামাণ্য অভিধান, পরিভাষা ও ব্যাকরণ রচনা, রেফারেন্স গ্রন্থ, গ্রন্থপঞ্জী এবং বাংলা ভাষায় বিশ্বকোষ প্রণয়ন, প্রকাশন ও সহজলভ্যকরণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার ব্যাপকতর ও সমৃদ্ধতর করিবার উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ।

১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানের অনুবাদ করার জন্য আলাদা একটি বিভাগও রয়েছে।

কিন্তু বাংলা একাডেমির সর্বশেষ প্রকাশিত বইয়ের তালিকায় দেখা গেছে, মোট ১৪১৮টি বিক্রয়যোগ্য বইয়ের মধ্যে অনুবাদ বইয়ের সংখ্যা একশর কম, যার বেশিরভাগই নব্বইয়ের দশকে প্রকাশিত হয়েছিল।

গত পাঁচ বছরে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত মোট ২১,৫২৭টি বইয়ের মধ্যে অনুবাদগ্রন্থের সংখ্যা ১৮৬।

জানতে চাইলে অনুবাদ বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা একশ অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশের জন্য একটি প্রকল্প তৈরি করতে কাজ করছি। আগামী মাস থেকে “অনুবাদ” নামে আমাদের একটি নতুন বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত হবে।’

জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম অবশ্য মনে করেন, একা বাংলা একাডেমির পক্ষে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। বরং এর জন্য শিক্ষাবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।

‘ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করি এবং ফেব্রুয়ারি চলে গেলে আবার ভুলে যাই’, মন্তব্য করে তিনি এই প্রবণতা থেকে সবাইকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানান।

Comments

The Daily Star  | English
probe committee for past elections in Bangladesh

Govt launches probe into last 3 national polls

The government has formed a committee to investigate allegations of corruption, irregularities, and criminal activities in the three national elections held in 2014, 2018, and 2024.

4h ago