‘একুশ এলে আমাদের ঘুম ভাঙে, একুশ চলে গেলে আবার ঘুমিয়ে পড়ি’
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ঘোষিত প্রথম মাতৃভাষা পদক-২০২১ প্রাপ্তদের মধ্যে জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা মথুরা বিকাশ ত্রিপুরার সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। তাদের কথায় উঠে এসেছে মাতৃভাষা নিয়ে তাদের প্রত্যাশা, হতাশা আর অনুভূতির গল্প।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা লেখা থাকলেও সত্যিকার অর্থে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। কেবল একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই এ নিয়ে আলোচনা হয়, আর সারাবছর কারও কাছে কোনো গুরুত্ব থাকে না।’
তার মতে, ভাষা নিয়ে সবচেয়ে বেশি নৈরাজ্য চলছে শিক্ষাক্ষেত্রে।
আর মথুরা বিকাশ ত্রিপুরার স্বপ্ন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রবর্তনকারী হিসেবে বাংলাদেশ তার আদিবাসীদের ভাষার অধিকার প্রশ্নে থাকবে অগ্রগামী।
পুরস্কারপ্রাপ্ত অন্য দুজন উজবেকিস্তানের নাগরিক ইসমাইলভ গুলম মিরজায়েভিচ ও বলিভিয়ার অনলাইনভিত্তিক সংগঠন অ্যাক্টিভিজমো ল্যাঙ্গুয়াজ। প্রতি দুই বছর অন্তর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটটিউট জাতীয় পর্যায়ে দুটি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুটি করে পদক দেবে।
জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তার প্রতিক্রিয়ায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন দেখেই আমাদের শুরু। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটেছে ভাষা আন্দোলন নিয়ে। কিন্তু যে ভাষা আন্দোলন থেকে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু, সেই স্বাধীন দেশে বাংলাকে এখনো আমরা পুরো রাষ্ট্রভাষা করতে পারিনি। নইলে স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন বিচারপতিদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হবে যে, দয়া করে রায়টা ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও দেবেন।’
তিনি বলেন, ‘এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? মোট কথা এসব বিষয় একুশে ফেব্রুয়ারি আসলেই আমরা আলোচনা করি, আর সারা বছর কোনো গুরুত্ব পায় না, মনেও পড়ে না। একুশ এলে আমাদের ঘুম ভাঙে, একুশ চলে গেলে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। এটাই আমাদের ট্র্যাজেডি।’
শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নৈরাজ্য চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে ছিল প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা। পাশাপাশি ইংরেজি বা অন্য ভাষাগুলো ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু ওই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। বরং আমরা উল্টোটা করেছি। কারণ আমাদের বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মিডিয়াম, আলিয়া মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা আরও কত কী আছে। আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সবই দরকার। কিন্তু আমরা কোনো ভাষাই ভালো করে শিখাচ্ছি না, এমনকি বাংলাও না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের বাইরে কোথাও বাংলার ব্যবহার নেই উল্লেখ করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরও ভার্সন ইংরেজি। আমরা অনেক সংগ্রাম করে একটা পেপার বাংলা ঢুকিয়েছি। কিন্তু কয়টা বিশ্ববিদ্যালয় সেটা অনুসরণ করে জানি না। আমাদের ভাষার জন্য মায়াকান্না শুরু হয়ে যায়, ভুলে যাই।’
প্রত্যাশার জায়গা প্রসঙ্গে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আশাকরি শিক্ষার মাধ্যম শিশু শ্রেণি থেকে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত বাংলা হবে। সেটা ইঞ্জিনিয়ারিং হোক কিংবা মেডিকেল হোক। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজিটাও থাকবে। উচ্চশিক্ষায় প্রচুর বাংলা গ্রন্থ রচনা হবে।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত আমাদের দেশে যে মাপের সাহিত্য, কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক হয়েছে, স্বাধীনতার পর কেন সেটি হয়নি? আমাদের সৃজনশীল প্রতিভা ওই ২৫ বছরে (পাকিস্তান শাসনামল) যা দেখেছিলাম, সেটা কোথায় গেল?’
‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে সাহিত্য সৃষ্টির কথা ছিল, সেটাই হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের অনেক কল্পনাধর্মী সাহিত্য আছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কল্পনা নয়, বাস্তব। এটা আমাদের সাহিত্যে আসেনি। মানুষের যে আত্মত্যাগ, দুর্ভোগ সেটা কোথায়? এটাই দুঃখ’, বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক এই শিক্ষক ও নজরুল গবেষক।
মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা খাগড়াছড়ির জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক। তিনি মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন, বিকাশ ও এসব ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম প্রণয়নের কাজ করেছেন বলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট থেকে বলা হয়েছে।
মথুরা বিকাশ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনো সরকারি হিসাবে ৫০টির মতো ভাষা রয়েছে। এই ভাষাগুলোর অধিকাংশের প্রচলন এখন কম। লেখালেখিও কম, কারণ এর পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা নেই। তাই ভাষাগুলো যেরকম বিকাশ হওয়ার কথা, সেরকম নেই। এর পেছনে সরকারের যদি অব্যাহত প্রক্রিয়া থাকে, তাহলে এই ভাষাগুলো হারিয়ে যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘এখন অনেকগুলো ভাষাই বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় আছে। সেগুলো আশা করি হারিয়ে যাবে না। প্রতিটি ভাষা যেন আত্মমর্যাদা নিয়ে টিকে থাকতে পারে, এমনটাই আমার প্রত্যাশা। কারণ কোনো ভাষা যদি হারিয়ে যায়, তবে সেই ভাষার বা সেই অঞ্চলের একটা জ্ঞানভাণ্ডার হারিয়ে যায়।’
২০২২ সাল থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে আদিবাসী ভাষা দশক উদযাপিত হতে যাচ্ছে উল্লেখ করে মথুরা বিকাশ বলেন, ‘এই দশক ধরেই আদিবাসীদের ভাষা নিয়ে কাজ করা হবে। মাতৃভাষা দিবসের প্রবর্তনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে নিশ্চয়ই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
আরও পড়ুন:
Comments