করোনা মহামারিতে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেড়েছে ৩ গুণ

করোনা মহামারিতে আয় কমে যাওয়া সত্ত্বেও সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সাধারণ মানুষ। ব্যাংকে টাকা জমা রাখার চেয়ে সুদের হার বেশি হওয়ায় জাতীয় সঞ্চয়পত্র কেনায় আমানতকারীদের আগ্রহও বেশি। এর মধ্যে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র বিক্রি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
Sonchoypotro
ছবি: সংগৃহীত
করোনা মহামারিতে আয় কমে যাওয়া সত্ত্বেও সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সাধারণ মানুষ। ব্যাংকে টাকা জমা রাখার চেয়ে সুদের হার বেশি হওয়ায় জাতীয় সঞ্চয়পত্র কেনায় আমানতকারীদের আগ্রহও বেশি। এর মধ্যে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র বিক্রি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
 
২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের বিক্রি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে সাত হাজার ৫৮১ কোটি টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। একই সময়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের যা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। অনেকে তাদের স্ত্রী এবং সন্তানের নামে সঞ্চয়পত্র কিনেছেন।
 
আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে সঞ্চয়পত্রের সামগ্রিক বিক্রি ৬০ শতাংশ বেড়ে ৫৪ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
 
ব্যাংকের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে মানুষের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ সুদের হার। সরকারি বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি সুদ দেওয়া হয় পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে। এর হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। বেশি পরিমাণে এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নামেও কেনার সুযোগ থাকায় তিন মাস মেয়াদী সঞ্চয়পত্রের বিক্রিও বেড়েছে।
 
গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে তিন মাস মেয়াদী সঞ্চয়পত্রের বিক্রি ১৫১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। এই সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক শূন্য চার শতাংশ। একক নামে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ এবং যৌথ নামে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ রয়েছে।
 
১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট অনুযায়ী জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
 
তিনি বলেন, করোনার কারণে আয় ও সঞ্চয় কমে যাওয়া এবং গত বছর থেকে বিনিয়োগের যোগ্যতা নিয়ে সরকারের কঠোর অবস্থানের পরেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে। ‘সম্ভবত এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি। ফলে বেড়েছে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র কেনার হার।’
 
তিনি আরও বলেন, বিদেশফেরত শ্রমিকরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন। এতে রেমিট্যান্সের অর্থ অপ্রাতিষ্ঠানিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে চলে এসেছে। সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার একক ও যৌথ নামে কেনার সর্বাধিক সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে।
 
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের একটি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি তিনটি সঞ্চয়পত্রে ৫০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে পারবেন না। এগুলো হলো— পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং পারিবারিক সঞ্চয়পত্র।
 
যৌথ নামে এই তিন ধরনের সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করা যেতে পারে। স্পষ্টতই ধনীদের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা থেকে নিরুৎসাহিত করার প্রচেষ্টা হিসেবেই এই সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
 
ব্যাংকগুলোতে আমানতের বিপরীতে সুদের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ফলে, দীর্ঘ মেয়াদে যারা ব্যাংকে টাকা রেখেছিলেন এবং রাখার কথা ভাবছিলেন তারা এখন ঝুঁকছেন জাতীয় সঞ্চয়পত্রের দিকে। আমানতের বিপরীতে ব্যাংকের গড় সুদের হার গত ডিসেম্বরে চার দশমিক ৬৪ শতাংশ থাকলেও জানুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে চার দশমিক ৫৪ শতাংশে। বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হারের তুলনায় সুদের হার কম।
 
জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এ বছর কোনো প্রশ্ন না তুলে অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার সুযোগ দেওয়ার কারণেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়তে পারে।’
 
গত জুলাই থেকে ডিসেম্বরে প্রায় ১০ হাজার ২২২ কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে। এ অর্থ কম সুদের কারণে ব্যাংকগুলোতে জমা করা হয়নি। দেশে সম্প্রতি রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১২ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার।
 
পাঁচ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্রের বিক্রি ২৫ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এই সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। একক নামে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ এবং যৌথ নামে ৬০ লাখ টাকার পাঁচ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্র কেনা যায়।
ট্যাক্স কমিশনারের অনুমতি সাপেক্ষে কৃষি ও মৎস্য ব্যবসায়ীরাও তাদের আয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারবেন।
 
জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ডাক সঞ্চয়পত্রের বিক্রি ২৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ কমে আট হাজার ৮০২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ক্রয় সীমা কমানোর ফলে ডাক সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে। একক নামে ১০ লাখ এবং যৌথ নামে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকার ডাক সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ রয়েছে।
 
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জানান, সুদের হার কম হওয়ায় ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহী হচ্ছে না সাধারণ মানুষ। আগে ব্যাংকগুলো যেখানে ছয় থেকে সাত শতাংশ সুদ দিত, এখন তা নেমে এসেছে তিন থেকে চার শতাংশে।
 
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, সঞ্চয়পত্র কেনায় সরকারের ক্যাপিং ভালোভাবে কাজ করেনি। তিনি বলেন, সরকার সীমা নির্ধারণ করে দিলেও স্ত্রী বা সন্তানদের নামে সঞ্চয়পত্র কেনার বিষয়টি দেখা হচ্ছে না। বর্তমানে বাজারে অর্থের তারল্য রয়েছে। তাই ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার পরিবর্তে সঞ্চয়পত্রে সবাই অর্থ বিনিয়োগ করছে বলে জানান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এই সাবেক কর্মকর্তা।
 
তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশের বন্ড বাজারের উন্নয়নে সহায়তা করছে না। বেশিরভাগ বন্ডের বছরের পর বছর ধরে লেনদেন হয়নি। ফলে এ জাতীয় ব্যবস্থা অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো না।’

Comments

The Daily Star  | English
Pro-Awami League journalist couple arrested

The indiscriminate arrests and murder charges

Reckless and unsubstantiated use of murder charges will only make a farce of the law, not bring justice to those who deserve it.

11h ago