কার গুলিতে মারা গেলেন সাংবাদিক মুজাক্কির?
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে গত শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মারা গেছেন সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির (২৫)। সংঘর্ষের চার দিন পেরিয়ে গেলেও কার গুলিতে মুজাক্কির মারা গেছেন- এখনও তা উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।
ঘটনার দিন গত শুক্রবার বিকেলে ত্রিপক্ষীয় গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
বসুরহাট পৌর মেয়র এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জা এবং কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়।
সংঘর্ষে ৯ জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ১০-১২ রাউন্ড রাবার বুলেট ছোঁড়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংঘর্ষের সময় উপস্থিত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার এক সাংবাদিক জানান, মির্জা কাদের ও বাদলের অনুসারীদের ধাওয়া, সংঘর্ষের ছবি তোলার সময় হামলাকারীরা মুজাক্কিরের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। এসময় তার মোবাইল ফোন ফেরত চাইলে হামলাকারীরা তাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়ে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মুজাক্কির।
তবে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের দাবি তাদের গুলিতে মারা যাননি মুজাক্কির। কাদের মির্জা ও মিজানুর রহমান বাদল মুজাক্কির হত্যায় একে অন্যের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন।
দুই গ্রুপের দাবি মুজাক্কির তাদের ‘লোক’
সাংবাদিক মুজাক্কির মারা যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপই হত্যার ঘটনায় রাজনীতি করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই গ্রুপের দাবি মুজাক্কির তাদের ‘লোক’ ছিলেন। কাদের মির্জা ও মিজানুর রহমান বাদল দুই জনই সাংবাদিক মুজাক্কির কে নিজেদের অনুসারী বলে দাবি করেছেন।
বসুরহাট পৌর মেয়র আবদুল কাদের মির্জা মুজাক্কিরের মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বলেন, সাংবাদিক মুজাক্কির একজন ভালো সাংবাদিক ছিলেন। তিনি দায়িত্ব পালনের সময় সংঘর্ষের ছবি তুলতে গেলে বাদলের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা তার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে তাকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে।
মুজাক্কির হত্যার জন্য বাদলকে দায়ী করে তার গ্রেপ্তার দাবি করেন কাদের মির্জা।
অপরদিকে বাদল গত শনিবার চাপরাশিরহাটে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মুজাক্কির তার এলাকার ছেলে। ২০১৯ সালে তিনি যখন উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন, তখন মুজাক্কিরসহ তার অনেক সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন কাদের মির্জা। সে মামলার সব খরচ বাদল বহন করেছিলেন বলেও দাবি করেন তিনি।
তিনি বলেন, কাদের মির্জার নেতৃত্বে তার লোকজন মুজাক্কিরকে গুলি করে হত্যা করেছে।
কাদের মির্জাকে সাংবাদিক হত্যাকারী আখ্যায়িত করে তার গ্রেপ্তার দাবি করেন তিনি।
তাহলে সাংবাদিক মুজাক্কির কার গুলিতে নিহত হলেন?
পুলিশ বলছে, দুই গ্রুপের সংঘর্ষ থামাতে ও সংঘর্ষকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও রাবার বুলেট ছোঁড়ে। কিন্তু পুলিশের গুলিতে কেউ হতাহত হয়নি।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা মীর জাহিদুল হক রনি জানান, চাপরাশিরহাটে সংঘর্ষের ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ পুলিশ বাজার পরিচালনা পর্ষদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে। সংঘর্ষের সময় কারা অস্ত্র নিয়ে গুলি করেছিল সেটি পুলিশ পর্যালোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।
পরিবারের বক্তব্য
সাংবাদিক মুজাক্কিরের পরিবার এখন পর্যন্ত থানায় কোন লিখিত অভিযোগ করেনি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তবে মুজাক্কিরের বড়ভাই নুর উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আগামীকাল মঙ্গলবার তারা মামলা করবেন।
তিনি জানান, কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভায় সোমবার ১৪৪ ধারা জারি থাকায় তারা মামলা করতে থানায় যেতে পারেননি। তবে এই মৃত্যুর জন্য তারা কাউকে দোষারোপ করছেন না বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, মামলার বাদি হবেন মুজাক্কিরের বাবা নোয়াব আলী মাস্টার।
নূর উদ্দিন বলেন, গোলাগুলির ঘটনাটি শুক্রবার আসরের নামাজের পর ও মাগরিবের নামাজের আগে ঘটে। সে সময় কারা গোলাগুলি করেছিল এবং কাদের ছোঁড়া গুলিতে মুজাক্কির গুলিবিদ্ধ হয়েছিল সেটা বাজারের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আছে। ওই ফুটেজটি পুলিশের হেফাজতে আছে বলে তিনি জানান।
মুজাক্কিরের খুনিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন তিনি।
তার কাছে জানতে চাওয়া হয় মিজানুর রহমান বাদল দাবি করেছেন মুজাক্কির তার সমর্থক ছিলেন এবং মুজাক্কিরের নামে থানায় মামলা ছিল--এ ব্যাপারে নূর উদ্দিন বলেন, তিনি এ বিষয়ে জানেন না এবং পরিবারের কারও কাছেও এ তথ্য নেই।
দুই মামলায় আসামি ১৩৪৪, গ্রেপ্তার হননি কোনো আসামি
কোম্পানীগঞ্জে সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় শনিবার রাতে মিজানুর রহমান বাদল বাদি হয়ে ৪৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও ৬০০ জন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলা করেন। একই ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ থানার এসআই রফিকুল ইসলাম অজ্ঞাত পরিচয় ৭০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত একজন আসামিও গ্রেপ্তার হননি।
পুলিশ বলছে, কোম্পানীগঞ্জের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি।
নোয়াখালী পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন বলেন, কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের দ্বন্দ্বে অস্থিরতা বিরাজ করছে। নিহত সাংবাদিক মুজাক্কিরকে নিয়ে দুপক্ষই রাজনীতি করার চেষ্টা করছে। পুলিশ এ ব্যাপারে সতর্ক আছে।
তিনি বলেন, আবদুল কাদের মির্জা ও মিজানুর রহমান বাদল উভয়ই নিহত মুজাক্কিরকে নিজেদের অনুসারী দাবি করে রোববার রাতে পৌরসভার রূপালী চত্বরে শোক ও প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। একই স্থানে এবং একই সময় দুপক্ষ সভা ডাকার কারণে বসুরহাট পৌর এলাকায় সোমবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এরপরই পৌরসভার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে বিদ্যুতের খুঁটি ও গাছের গুঁড়ি ফেলে সড়ক অবরোধ করা হয়। পুলিশ ও র্যাব সকাল থেকে সেগুলো সরিয়ে ফেলতে কাজ করেছে। এখানকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পুলিশ রাতদিন কাজ করছে। যার কারণে মামলা দুটির তদন্ত কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। যতদ্রুত সম্ভব মামলা তদন্ত করে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে।
আরও পড়ুন-
কোম্পানীগঞ্জে গুলিবিদ্ধ সাংবাদিক মুজাক্কির মারা গেছেন
কোম্পানীগঞ্জে নিহত সাংবাদিক মুজাক্কিরের দাফন সম্পন্ন
সাংবাদিক মুজাক্কির হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম
Comments