সৈয়দ আবুল মকসুদের একলা চলা
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যখন বিশ্বের দরবারে বেশ সমীহ আদায় করছে, তখন সেই দেশেরই একজন বেছে নিলেন সেলাইবিহীন কাপড় পরার। সুই-সুতায় যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি সেলাইবিহীন সাদা কাপড়ে মানবিক বিশ্ব গড়ার এক অসম্ভব মিশনে একাই নেমে পড়লেন।
তিনি আমাদের সৈয়দ আবুল মকসুদ। যাকে আমরা ‘মাকসুদ ভাই’ বলে ডাকতাম।
সময়টা ২০০৩ সাল। যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাকে আক্রমণ করে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা শুরু করে, তখন তিনি এর প্রতিবাদে শান্তির রং সাদা কাপড় পরে প্রতিবাদ জানান। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির অনুসারী সেলাইবিহীন দুখণ্ড কাপড় পরে সেই যে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন।
সমাজের অনেকে যখন অর্থ-বিত্তের পিছনে ছুটছিলেন, তখন মকসুদ ভাই গভীর মনোযোগে মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের গবেষণায় ব্যস্ত। দুহাত ভরে লিখে গেছেন প্রবন্ধ, ভ্রমণ গদ্য, সমসাময়িক বিষয়ে কলাম ও কবিতা।
সমাজের চারপাশে যখন মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়, তখন তিনি তার আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে এক পা পিছপা হননি। শুধু কাপড়ে না, খাবার-দাবার ও চলনেও ছিলেন খুব সাদামাটা। উনি মাংস খেতেন না। বড় কোনো হোটেলে খেতেন না। এমনকি পাশ্চাত্যের ওষুধও তিনি বর্জন করেছিলেন।
যে বছর এই বঙ্গে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েক হাজার লোক মারা যায়, সে বছরই বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন আবুল মকসুদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে পড়াশোনা করলেও সাহিত্যের ঝোঁক ছিল আজীবন। তাই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল মনসুর আহমেদ ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে করেছেন বিস্তর গবেষণা। তাদের জীবন ও দর্শন নিয়ে লিখেছেন সারাজীবন।
জীবনের পুরোটা সময় ধরেই করেছেন সাংবাদিকতা। তার কলামের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধন। যা তার হাতের পরশে হয়ে উঠত সুখপাঠ্য।
তিনি প্রথম আলো পত্রিকায় প্রতি মঙ্গলবার কলাম লিখতেন। কী আশ্চর্য সেই মঙ্গলবারই থেমে গেল তার কলম। ছাপা হবে না আর কলাম।
শুধু কি লেখালেখি? না, নিজের জীবনের একটা অংশ ব্যয় করেছিলেন গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায়। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন থেকে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন। কোথায় ছিলেন না শান্ত, সৌম্য ও প্রচণ্ড রসবোধের অধিকারী এই মানুষটি। নরম গলায় সহজ ভাষায় কঠিন সব কথা লিখতে যেমন পারদর্শী ছিলেন, ঠিক তেমনি বলাতেও।
প্রচণ্ড আশাবাদী ও বাস্তববাদী মকসুদ ভাই চেয়েছিলেন পৃথিবীটা হবে সবার বাসযোগ্য। থাকবে না যুদ্ধ, থাকবে না কোনো অনাচার। সেই স্বপ্নের পৃথিবী তিনি দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু আমাদের সামনে রেখে গেলেন দৃঢ়তার এক উদাহরণ। একাই লড়ে যাওয়া যায়- যদি ইচ্ছেটা হয় প্রকট ও আন্তরিক।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বদেশী যুগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ২২টি প্রতিবাদী সঙ্গীতের মধ্যে একটা গান ছিল ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানটি গিরিডি শহরে বসে লিখেছিলেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে গানটি বঙ্গভঙ্গের সময়কালে একটি বিখ্যাত প্রতিবাদী গান রূপে জনমানসে বিখ্যাত হয়। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী এই গানের সুর দেন।
মহাত্মা গান্ধী এই গানের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। রবীন্দ্র ও গান্ধী ভক্ত সৈয়দ আবুল মকসুদ একাই লড়ে গেছেন। আবার একাই তিনি চলে গেলেন।
Comments