লস্ট ইন (সিলেটি) ট্রান্সলেশন
মানুষ যখন জানতে পারেন যে, আমার বাড়ি সিলেট তখন আমাকে প্রথম যে প্রশ্নটি করা হয় তা হলো আমি সিলেটি ভাষা পারি কিনা? আমরা যে সাধারণ বাংলা ভাষায় কথা বলি তার চাইতে সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক ভাষা এতটাই আলাদা যে এটাকে প্রায়ই এটাকে আলাদা একটি ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই ধরনের প্রশ্নের উত্তরে আমি কৌতুকছলে বলি, ‘থুরা, থুরা’ (কিছুটা সিলেটি বলতে পারি)।
কিন্তু, আমি তাদেরকে সত্যটা বলি না। আমি তাদের বলি না যে, তারা যখন মজা করে প্রত্যেকটা সিলেটি শব্দকে অদ্ভুতভাবে উচ্চারণ করেন, তখন আমার নানি-দাদিরা যে সাবলীলভাবে কথা বলেন সেটা আমার মনে পড়ে যায়। আমি তাদের বলি না যে প্রয়োজন হলে আমিও সম্ভবত সিলেটি ভাষাতেই পুরো কথাবার্তা চালাতে পারব।
আমি কিছুই বলি না। কারণ, ঢাকার মতো মহানগরীর সামজিক সার্কেলে আঞ্চলিক ভাষাগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। আমি কিছুই বলি না— কারণ, তাদের কাছে সিলেট একটি রহস্যময় জায়গা। যেখানকার সমস্ত বাসিন্দা কোনভাবে লন্ডন শহরের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং যেখানকার মানুষ এমন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন যা অন্য অনেকের কাছে ‘হাস্যকর’!
সিলেটিরা নির্দিষ্ট কিছু আবেগকে এতো যথাযথভাবে তাদের ভাষায় প্রকাশ করতে পারে যে এটা ভাবলেই অবাক হতে হয়। ‘কিতা কিতা খরে’ বুলির মাধ্যমে মনের কষ্ট থেকে হৃদয় ভাঙার দুঃখ— এমন অবর্ণনীয় বিস্তৃত অনুভূতিও বোঝানো যেতে পারে।
যেকোনো শারীরিক কিংবা মানসিক যন্ত্রণাকে এ ভাষায় ‘বিষ’ শব্দটি দিয়ে বোঝানো হয়। কখনো কখনো মারাত্মক শারীরিক ব্যথা এ ভাষায় হয়ে যায় ‘ব্যাদনা’।
ক্লান্তিকর কোনদিনের শেষে শারীরিক অবস্থা বোঝাতে ‘শোরির ভাইঙ্গা ফরে’র মতো উপযুক্ত শব্দ আর নেই।
সিলেটি ভাষার সম্ভবত আশ্চর্যজনক একটি শব্দ হচ্ছে ‘বেঙ্গলি’। সিলেটি নন এমন মানুষজনকে সিলেটিরা ‘বেঙ্গলি’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। ব্রিটিশ আমলে ভারতভাগের আগে সিলেট বাংলার অংশ ছিল না। ১৮৭৪ সালে এটিকে আসাম রাজ্যের একটি অংশ করা হয়েছিল।
আমার পরিবারে আমার দাদা-দাদির প্রজন্ম ও আমার বাবা-মায়ের প্রজন্ম তাদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে এই ভাষাতেই অনায়াসে কথোপকথন চালিয়েছেন। কিন্তু, আমাদের তরুণদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় তারা সবসময় ‘শুদ্ধ বাংলা’-তেই কথা বলার চেষ্টা করেন। ফলে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে আমাদেরকে পড়তে হয়। আমরা সবাইকে একটা ভাষা বলতে শুনতাম ঠিকই, কিন্তু নিজেরা সে ভাষায় কথা বলার সুযোগ পেতাম না।
এর পেছনের কারণটা আমি বুঝতে পারি। বাসায় আমাদেরকে বাংলা শেখানো হতো এবং বাসা ও স্কুল— দুই জায়গাতেই আমরা ইংরেজি শিখতাম। কারণ পরিবারের ভয় ছিল যে আমাদের হয়তো কেবল সিলেটি অথবা ইংরেজি ভাষাতেই কথা বলার অভ্যাস গড়ে উঠবে। যেমনটা লন্ডনে বসবাসরত ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের মধ্যে দেখা যায়। আমাদের প্রবীণরা আমাদের ক্ষেত্রে এটি এড়াতে চেয়েছিলেন।
ফলে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শেখার এবং নিখুঁতভাবে বলতে পারার মধ্যে সিলেটি আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব হারিয়ে গেছে। এটি আমাদের কাছে রয়ে গেছে পারিবারিক উত্তরাধিকারের একটি পুরানো অংশের মতো। এটি মূল্যবান, তবে কোনভাবেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অবদান রাখছে না।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষাটি যেন আমাকে তাড়া করছে। হ্যাঁ, আমি শুনতে পাই যে বাড়িতে এ ভাষায় কথা বলা হচ্ছে। অনেক সময় মজা করে আমিও প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলার সময় এলোমেলো কয়েকটি শব্দ বলে ফেলি। ‘জি ওয়’ (হ্যাঁ) কিংবা ‘বালা’ (ভালো)। আমার ভাণ্ডারে এই সিলেটি শব্দগুলোই রয়েছে।
এই ছোট্ট শব্দগুলো আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছে। সিলেটি শব্দ প্রিয়জনদের আরও বেশি ঘনিষ্ঠ করে তোলে। কখনো কখনো আমি ভাবি একদিন হয়ত এই ভাষাটি আমার জীবন থেকে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যাবে। যদি তা হয়, আমি নিজের একটি নির্দিষ্ট অংশ হারাব। কারণ, সিলেটি আমার পরিচয় ও আমার সত্ত্বায় জড়িত।
Comments