একটি কুঁড়ি দুটি পাতার জন্য ভালোবাসা
বৃষ্টির শহর সিলেটের জন্য ভালোবাসা। ভালোবাসা সবুজ শহরটির জন্য। পবিত্র ভূমির শহরের জন্য।
স্মরণীয় জায়গাগুলো
প্রায় সময়ই ফোন নষ্ট হয়ে গেলে আমাদের গন্তব্য ছিল করিমুল্লাহ মার্কেট। সেখানে হাজারো টেক শপের সমুদ্রে আমরা হারিয়ে যেতাম। প্ল্যানেট আরাফের দোকানগুলোতে আমরা যখন র্যাম স্টিক খুঁজে বেড়াই তখনই রাজা ম্যানশন থেকে নতুন বই-লিফলেটের গন্ধ ভেসে আসত। আমরা কেবল গন্ধ নিয়েই খুশি থাকতাম, বই কেনার সুযোগ ছিল কম। বইয়ের প্রসঙ্গে বাতিঘরের কথা না বললেই না।
আল হামরা শপিং মলেও প্রায়ই যাওয়া হতো আমাদের। বেশিরভাগ সময়ই কিছু কিনতে যেতাম না। শৈশবে সেখানে গিয়ে বাবা-মায়ের হাতে পায়ে ধরতাম একটা ইয়ো ইয়ো কিংবা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ির জন্য।
স্পাইসি রেস্টুরেন্টে যাওয়ার ব্যাপারে আমরা ব্যাপক আগ্রহী ছিলাম, তবে উদ্দেশ্য ছিল সিটি সেন্টারের ওপর থেকে গোটা শহরটাকে দেখা। লতিফ সেন্টার— পুরো শহরের এই একটা দোকান থেকেই আমরা সিডি কিনতাম।
বৃষ্টির শহর সিলেট
বৃষ্টি শুরুর সময় সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায়। কখনো কখনো আমরা বারান্দা থেকে বৃষ্টি দেখতাম, ঝিরিঝিরি শব্দ শুনতাম, মাটির গন্ধ পেতে চাইতাম। কখনো বা বসে পড়তাম পছন্দের কোনো বই নিয়ে। কখনো আবার ছাদে না গিয়ে থাকতেই পারতাম না, বৃষ্টি আমাদের ভিজিয়ে দিতো! আবার যখন জীবন আমাদের প্রতি খুব একটা সদয় হতো না, তখন ভেজা পোশাকে তিন ঘণ্টা ক্লাসও করতে হয়েছে। সেসময় বৃষ্টি আমাদের পুরো দিনটাই নষ্ট করে দিয়েছে বলে মনে হতো।
সিলেটের খাবার
পাঁচ ভাই রেস্তোরাঁয় মধ্যাহ্নভোজ। নতুন নতুন ভর্তা চেখে দেখা। ভর্তাগুলো চেনার একমাত্র উপায়ই হলো তাদের স্বাদ। আমরা অপেক্ষা করতাম বেগুন ভাজির জন্য। পানশীতে কাটানো বিকেল, দীর্ঘসময় অপেক্ষার পর গরুর চাপ অর্ডার করা। সেসব সন্ধ্যা, কোচিংয়ের ক্লাসের নিষ্ঠুর সময় শেষে ফয়েজ স্ন্যাকসের গরম জিলাপি বা পালকির লনে কাটানো সময়।
গ্লাসের পর গ্লাস লেবুর সরবত খেতে খেতে যারা প্রকাশ্যে ধূমপান করতো তাদের দিকে রূঢ় চাহনি। সুফিয়ার দই চিড়া, ভোজন বাড়ির খিচুড়ি, নুরু ভাইয়ের চটপটি, আর্টিসানের হট চকলেট ও প্রেসিডেন্ট রেস্টুরেন্টের বিরিয়ানি। আর হ্যাঁ, আর্কেডিয়ার ফুডকোর্টটিও বা ভুলি কী করে?
শাবিপ্রবির জন্য ভালোবাসা
কোনো মনের মানুষের সঙ্গে শাবিপ্রবির এক কিলোমিটার রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো। নিউজিল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া হেঁটে বেড়িয়েছি! শিক্ষার্থীরাই এই দুটো জায়গার নাম দিয়েছেন— যেন তারা প্রতিদিনই বিশ্ব ভ্রমণের স্বাদ দিতে চাইছেন। ক্লাবের কাজের নামে ক্লাস ফাঁকি দেওয়া।
ক্লাবের কাজ বলতে ছিল সেন্ট্রাল ক্যাফেটেরিয়া থেকে সিঙ্গারা ভাগ করে খাওয়া ও ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের কাছে ফুচকা খাওয়া।
সিলেটের পবিত্র ভূমি
আমরা যতবার অ্যাডভেঞ্চারে গিয়েছিলাম, এই বিশাল গোলকধাঁধায় ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে থাকা ৩৬০টি মাজার খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি। যদিও আমরা মনে মনে জানতাম যে আমরা কখনই সবগুলো দেখতে পাবো না।
শৈশবে হযরত শাহজালাল (র.) ও হযরত শাহ পরান (র.) এর মাজারে সফর, পাখি ও মাছদের খাওয়ানোর দৃশ্য দেখে সুন্দর সময় কেটেছে। আমরা কয়েক শ মসজিদে নামাজ পড়েছি। নামাজ শেষে প্রবীণরা যখন ধর্মীয় আলোচনার জন্য আমাদের আরও এক ঘণ্টা ধরে রাখতে চাইতেন তখন আমরা সেখান থেকে দৌঁড়ে পালিয়েছি।
সিলেটের যানবাহন
সাইকেল করে তেমুখী পর্যন্ত যাওয়ার দিনগুলি খুব মনে পড়ে। এয়ারপোর্ট পর্যন্ত দীর্ঘ যাত্রা শেষে দলের সবাই মিলে বাচ্চু মিয়ার স্টলে টি-পার্টি করি। কখনো কখনো যখন আমরা আরেকটু অ্যাডভেঞ্চার চাইতাম তখন বাইশটিলা যেতাম। চা-বাগানের দুই পাশেই তাকিয়ে থাকা, বাইপাসে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত যাত্রা— যা শেষ পর্যন্ত আর কখনোই হয়নি।
ডাউনহিল বাইকিং প্রতিযোগিতা ও সেগুলোর ভিডিও তৈরি করা এবং সেগুলো হারিয়ে ফেলার কথা মনে পড়ে। আমরা বাইকিং গ্রুপ তৈরি করি।
এরপর শহরের ভেতরে ধীরগতির সাইকেল যাত্রা শুরু হয়। সাইক্লিংয়ের জন্য এটি যদি সেরা শহর না হয় তবে কোনটি হবে? সাইকেলে চড়ে এ শহর উপভোগ করার জন্যে যথেষ্ট বড়। আবার দৈনন্দিন কাজের জন্য সাইকেল ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট ছোট।
চা-বাগান
সমস্ত শৈশবজুড়ে আমরা ভাবতাম মালনিছেড়া, লাক্কাতুরা ও তারাপুর থেকে চা-পাতা তুলে নিয়ে সরাসরিই সেগুলো থেকে চা তৈরি করা যাবে। চা-বাগানে আমাদের হারিয়ে যাওয়ার সবগুলো মুহূর্তের জন্য ভালোবাসা রইল।
হেঁটে বেড়ানোর রাস্তা, ব্রিজের শহর
মনে পড়ে— আম্বরখানা পয়েন্টের ট্র্যাফিক জ্যাম। চৌহট্টায় তরুণদের নিয়মিত বিক্ষোভ ও আন্দোলন। হাউজিং এস্টেটের নির্জন রাস্তায় একাকী হেঁটে যাওয়া। ঈদগাহে আমরা কতো সময় কাটিয়েছি! ইকোপার্কে ছিল আমাদের রোমান্টিক পদচারণা। চঞ্চল রোডে মাঝরাতে হেঁটে বেড়ানো— কেউ ভুলতে পারে কি?
দিনের প্রথম ঘণ্টায় রঙ চা হাতে কীন ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা, ব্রিজের ওপর গাড়ি যাওয়ার সময় কংক্রিটের কাঁপুনি অনুভব করা, দিনের শেষ বেলায় কাজীর বাজার ব্রিজে কাটিয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে ঝালমুড়ি খাওয়া, সূর্যাস্ত দেখা, তেমুখী ব্রিজে কাটানো বিকেল, শহরে উপকণ্ঠে ঘুরোঘুরি এবং একটি সুন্দর দিনের শেষ— মনে পড়ে।
মনে পড়ে— বন্ধুদের নিয়ে বিছানাকান্দি, জাফলং, শ্রীমঙ্গল, রাতারগুল, সাদাপাথর, ভোলাগঞ্জ, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, বাইক্কা বিল, মাধবপুর লেক, তামাবিল ও জৈন্তিয়ায ভ্রমণ। জীবনে যেখানেই যাই না কেন এ জায়গাগুলো কখনোই ভোলার মতো না।
তারপরে এমন সময় আসে যখন চারপাশে একটু বেশি বাঁধা বলে মনে হয়, জায়গাটাকে ছোট মনে হয়, মনে হয় যেন এখান থেকে পালালেই ভালো। যেকোনো ছোট শহরের মতোই আপনার একটি অংশ এ শহর থেকেও চলে যেতে চাইবে, উড়ে যেতে চাইবে এবং আরেকটি অংশ থাকতে চাইবে চিরদিনের জন্য। সমস্ত শহরের মতো এই শহরেও একই প্যারাডক্স।
কিন্তু, তারপর একসময় স্থিরতা আসে। সমস্ত পরিচিত মুখ ও তাদের পরিচিত হাসি নিয়ে এই শহর আমাদেরকে সুরক্ষিত রাখে, স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করায়।
এখানেই আমাদের বাড়ি। এই সিলেটেই।
Comments