উচ্চশিক্ষা উন্নয়নের সম্ভাব্য রোডম্যাপ
মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার পাঠ আসে শিক্ষা থেকে, এই ব্যবস্থায় সামান্য গলদও সমাজে বহু সমস্যার জন্ম দেয়। দেশে মূল্যবোধের ক্রমাগত অধঃপতন বোধ করি শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান বিভিন্ন অসঙ্গতির প্রতিফলন। জ্বলন্ত একটা উদাহরণ হচ্ছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জাতীয় কারিকুলামের ইংরেজি ভার্সন। অথচ ফেব্রুয়ারি মাস এলে ভাষার প্রতি আমাদের দরদ উপচে পড়ে! ভিন্ন আরেকটি উদহারণ দেখা যাক। কয়েকদিন আগে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক সংস্থা ইউজিসি কয়েকজন উপাচার্যের একটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে যারা একজন আরেকজনের অনিয়মের পাহারাদার (যুগান্তর, ১৬ ফেব্রূয়ারি)। হবেই না কেন, উপাচার্য হতে যে অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় হয়! তাই দায়িত্ব পেয়েই কেউ কেউ বনে যান প্রতিষ্ঠানটির একচ্ছত্র অধিপতি, হয়ে উঠেন 'অতি রাজনৈতিক'। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার হালচালের দুটি উদহারণ আমাদের সার্বিক ধারণা দেয়। অর্থাৎ প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত রয়েছে ব্যাপক অসংগতি, বিশৃঙ্খলা।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য নিয়োগ ও পদোন্নতি বিষয়ে ইউজিসি সম্প্রতি একটি অভিন্ন নীতিমালার খসড়া করেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ-পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা আনা বা মেধাবীদের আকৃষ্ট করা। কিন্তু নীতিমালাগুলোর বেশ কিছু ধারা বৈশ্বিক অনুসৃত নিয়মাবলীর সাথে সাংঘর্ষিক। আবার অনেক ধারার অস্পষ্টতায়, কেউ মানছে আর কেউ মানছে না। দেশের বাস্তবতায় নিয়মগুলো মানাও কষ্টকর। এহেন নীতি চূড়ান্তকরণে অন্তত দুটি বিষয় প্রাধান্য দেয়া উচিত: (১) শিক্ষকতা ও গবেষণায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে এমন ব্যক্তিদের অন্তৰ্ভুক্তি তবে কোনোভাবেই 'রাজনীতিবিদ শিক্ষক' নয় এবং (২) স্বনামধন্য দেশি/বিদেশি অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের মতামত নেওয়া। অভিন্ন নীতিমালাগুলো দেখলে মনে হবে ইউজিসি অনেকটা দায়সাড়া গোছের কিছু করেছে বা সম্ভব: সুনির্দিষ্ট কাউকে বা গোষ্ঠীকে খুশি করতে চাওয়া।
নিত্যনতুন প্রযুক্তি বিশ্বের উচ্চশিক্ষা পদ্ধতি চটজলদি বদলে দিচ্ছে। বিভিন্ন শাস্ত্রের প্রসারতা বৃদ্ধির সাথে হুহু করে বাড়ছে বাণিজ্য। উন্নত দেশগুলোর এই ব্যবসা অনেককাল ধরে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে আমরা কিন্তু সুযোগটা নিতে পারি। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক সময় অনেক বিদেশি পড়ত, সময়ের সাথে কমছে তাদের সংখ্যা। ভারত, মালয়েশিয়ায় বর্তমানে উচ্চশিক্ষার রমরমা ব্যবসা। এত বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরেও আমরা পারছি না কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে, বাড়ছে না বিদেশি শিক্ষার্থী। মূলতঃ নড়বড়ে ভিত, পথভ্রষ্ট ও কর্মবিমুখ শিক্ষা আর তথাকথিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি এর জন্য দায়ী। তাই উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে নিম্নলিখিত উদ্যোগগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে।
এক. নিয়োগ-পদোন্নতিতে কানাডিয়ান কিংবা অস্ট্রেলিয়ান ইমিগ্রশনের মতো পয়েন্ট চালু। প্রার্থী নিজেই জানবে সে আবেদনের যোগ্য কিনা। শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বিভিন্ন একাডেমিক অর্জনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পয়েন্ট বন্টিত হতে পারে। পূর্ববর্তী ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ তবে তার চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ প্রার্থী কোন প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতর ডিগ্ৰি নিয়েছে এবং স্ব-ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে লেখক হিসাবে প্রকাশনার সংখ্যা। প্রসঙ্গত, প্রথম শ্রেণি পেলেই শিক্ষক ধারণাটির পুনর্বিবেচনা দরকার। একটা নির্দিষ্ট বছর থেকে নিয়মগুলো বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, যেমন ২০২৫ বা ২০৩০ সাল। একটা সাব এবং একটা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটি থাকতে পারে যারা প্রাপ্ত উপাত্ত বাছাই করে সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে সাক্ষাৎকার নেবে। সাব-কমিটি উপযুক্ত প্রার্থীর তালিকা আরও সংক্ষিপ্ত করে কেন্দ্রীয় কমিটিকে সুপারিশ করবে আর সর্বোচ্চ কমিটি স্বচ্ছতা ও মেধা নিশ্চিতে, প্রয়োজনে আবারও সাক্ষাৎকার নেবে। কমিটির মেম্বারদের কাছে থাকবে সর্বনিম্ন মার্ক যাতে কেউ ব্যক্তি চরিতার্থ হাসিল করতে না পারে বা রাজনৈতিক রং দিয়ে মেধাবীদের বঞ্চিত না করতে পারে। এতে যেমন প্রচলিত পদ্ধতি ধীরে ধীরে অকার্যকর হবে তেমনি সমন্বয়ের সুযোগ থাকবে। একইসাথে, বাবা, মামা, চাচার দৌরাত্ম হ্রাস পাবে। মনে রাখা দরকার ভালো ছাত্র মানেই ভালো শিক্ষক না আর নিয়োগ-পদন্নোতিতে মেধাবীদের প্রাধান্যে নিশ্চিতে দীর্ঘমেয়াদি উপকারিতা বহুবিধ।
দুই. সম্ভবত আমরাই একমাত্র জাতি যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জবাবদিহির কোনো বালাই নাই, রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলে বোনাস হিসাবে পদপদবি আর ক্ষমতার দাপট। এহেন অবস্থা কোনোভাবেই নৈতিক ও মেধাবীদের আকৃষ্ট করে না। নব্য নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির অনেক বিষয় অজানা থাকে, এই সুযোগ 'অ-মেধাবী চক্র' হাত ছাড়া করে না। বিভিন্ন লোভ ও মিথ্যা আশ্বাসে মেধাবীকে করে পথভ্রষ্ট ও বিপথগামী। তাই সবক্ষেত্রে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি চালু করা অতি অত্যাবশ্যক। 'ভালো কাজে পুরস্কার খারাপ কাজে তিরস্কার' - এমন স্লোগানের দুই-তিনটা উদহারণ রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে বাস্তবায়ন করলে মেধাবীরা এগিয়ে আসবে নতুন উদ্ভাবন ও জ্ঞানের আবিষ্কারে যা টেকসই ও উন্নয়নবান্ধব।
তিন. যদিও বৈশ্বিক বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং দেশের নীতিনির্ধারকেরা বেশি আমলে নেন না, বহির্বিশ্বে বর্তমানে বৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীর স্নাতকোত্তর প্রতিষ্ঠানের র্যাংকিং অত্যন্ত গুরুত্ববহ, এক্ষেত্রে রয়েছে নির্দিষ্ট পয়েন্ট। এমন পদ্ধতি দেশের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে দ্রুত অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, অর্থাৎ প্রার্থীর উচ্চতর ডিগ্রির প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক অবস্থান ধর্তব্যে নেয়া উচিত কেননা মানসম্মত প্রতিষ্ঠান গুণগত শিক্ষা দিতে সদা সচেষ্ট। এক সময় পিএইচডি ছাড়াই নিয়োগ হতো কিন্তু এই প্রথা বিলোপ সময়ের দাবি। তবে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া পিএইচডির মান নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ সুতরাং তাদের নিয়োগ, প্রতিষ্ঠানের সর্বনাশের পরিবর্তে মহাসর্বনাশ করে ফেলতে পারে।
চার. শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নাই। বিশ্বব্যাংকের মতে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরাই শিক্ষায় সর্বনিম্ন বিনিয়োগকারী। আজকে দক্ষিণ কোরিয়া বা চীনের যে উন্নতি তা কিন্তু যুগোপযোগী শিক্ষা, দক্ষ মানবসম্পদ আর গবেষণায় অঢেল বিনিয়োগ। ২০০০ টাকা বিনিয়োগে রাতারাতি ১০০ কোটি টাকা বানানো অলীক কল্পনা। তাই দরকার বিনিয়োগ বাড়ানো তবে সেটা হতে হবে চাহিদার ভিত্তিতে। জ্ঞান উৎপাদনের নিমিত্তে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিশন, ভিশন আর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশলপত্র প্রণয়ন জরুরি।
পাঁচ. গবেষণার মান ও সংখ্যা বাড়াতে প্রয়োজন মানসম্পন্ন পোস্ট ডক্টরাল গবেষক। ইউজিসির খসড়া অভিন্ন নীতিমালায় এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। অথচ উন্নত দেশগুলোতে পিএইচডি এবং পোস্টডক্টরেট গবেষকগণ আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে মানসম্মত প্রকাশনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে ব্যাপক অবদান রাখে।
ছয়. চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাথে টিকে থাকার জন্য যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন তাই প্রযুক্তিভিত্তিক মানবসম্পদ গড়ার প্রতি নজর দেয়া বাঞ্ছণীয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় তাই সময়োপযোগী উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি প্রায়োগিক ও কারিগরি শিক্ষার উপর জোড় দেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। প্রয়োজনে উন্নতদেশের মতো দীর্ঘমেয়াদি (৩০ বৎসর) শিক্ষা ঋণ চালু করা যেতে পারে। এতে করে শিক্ষার্থীদের পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়বে, কমবে পরিবার নির্ভরতা। পার্শ্ববর্তী ভারতেই এমন পদ্ধতি রয়েছে।
সাত. চাটুকারদের বাদ দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করা উচিত। এ সমস্ত লোকজন শুধু দেশের বা সমাজের ক্ষতিই করছে না, 'ঋতুভিত্তিক' এই শ্রেণী নিজেরটা ষোলো আনা বোঝে আর দেশের ক্ষেত্রে এক আনা ও বোঝে না। তারা নিজেদেরকেও যুগোপযোগী করে না বরং যারা করতে চায় তাদেরকে বিভিন্ন উপায়ে করে শেকলবন্দি।
উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো ধর্তব্যে নিলে পরিবর্তন আসতে বাধ্য, দরকার শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও মেধার মূল্যায়ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি মানেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এমন ধ্যানধারণা থেকে নীতিনির্ধারকদের বের হয়ে আসা উচিত। ছোট একটা ভাল কাজ সমাজে বড় পার্থক্য করে দিতে পারে। ভালো কিছু পেতে হলে ব্যক্তি/গোষ্ঠীগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হবে। নতুবা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাবিদদের 'উচ্চশিক্ষার বুদ্বুদ' তত্ত্ব অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক সমস্যা প্রকট হতে বাধ্য যার কিছু কিছু এখনই দৃশ্যমান।
লেখক: স্কুল অব আর্থ এন্ড প্ল্যানেটারি সাইন্সেস, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments