ভারত ভ্যাকসিন কূটনীতিতে যেভাবে হারালো চীনকে

করোনা ভ্যাকসিন তৈরিতে ভারতের সাফল্য ভ্যাকসিন কূটনীতিতে চীনকে হারিয়ে দিয়েছে।
vaccine
ছবি: এএফপি ফাইল ফটো

করোনা ভ্যাকসিন তৈরিতে ভারতের সাফল্য ভ্যাকসিন কূটনীতিতে চীনকে হারিয়ে দিয়েছে।

সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ’র এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে চীনের যে প্রচেষ্টা তাতে চীনকে পেছনে ফেলে দিয়েছে ভারত।

বেইজিং ও নয়াদিল্লি দীর্ঘদিন ধরে এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা করে আসছে। করোনা মহামারিতে এই দুই দেশ কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সীমান্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। এরপর থেকেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েই চলছে। টিকটকসহ কয়েক শ চীনা অ্যাপ ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এছাড়াও, বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। দেশটি জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে।

অন্যদিকে, বেইজিং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’র আওতায় কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়ে গরিব দেশগুলো সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করছে।

কিন্তু, করোনা মহামারি চীনকে ছাপিয়ে ভারতকে বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার কূটনৈতিক সুযোগ করে দিয়েছে। ভারতের ওষুধ শিল্প, বিশেষ করে দেশটির সেরাম ইনস্টিটিউট, ইতোমধ্যেই উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রধান ওষুধ সরবরাহকারী সংস্থা হয়ে উঠেছে।

গরিব দেশগুলোতে কম দামে কিংবা বিনামূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহ করে আগামী কয়েক বছর বিশ্ববাজারে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ ছিল চীনের। প্রাথমিকভাবে বেইজিং দৃঢ় অবস্থানেও ছিল।

গত বছর নিজ দেশে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে ভ্যাকসিনের উত্পাদনকে গতিশীল করেছে চীন। অন্যদিকে, ভারতেও করোনা সংক্রমণ মারাত্মক আকার নেয়। দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে গত ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ভারতের অর্থনীতি মন্দায় পড়ে।

বিশ্বজুড়ে জনগণের আস্থা তৈরিতে চীনের ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলো তাদের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের বিবরণ প্রকাশ করে। চীনের ১৪০ কোটি জনগণকে সুরক্ষিত করতে তারা নিজ দেশে জরুরিভিত্তিতে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করে এবং চীনের জনগণকে ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়।

অন্যদিকে, ভারত নিজ থেকে ভ্যাকসিন কর্মসূচি শুরুর কম সময়ের মধ্যেই প্রতিবেশী নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকায় কয়েক লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাঠিয়েছে। ফলে এই দেশগুলো চীনের ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষা না করে টিকা কর্মসূচি শুরু করে দিয়েছে।

শ্রীলঙ্কার বিরোধীদলের আইনপ্রণেতা এরান বিক্রমরত্নে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভারতের উপহারের কারণে শ্রীলঙ্কা দ্রুত টিকা কার্যক্রম শুরু করতে পেরেছে। বেশিরভাগ শ্রীলঙ্কান এ জন্য কৃতজ্ঞ।’ তিনি নিজেও ভারতীয় টিকা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

এখন পর্যন্ত নয়াদিল্লি বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬৮ লাখ ভ্যাকসিন বিনামূল্যে সরবরাহ করেছে।

ব্লুমবার্গ’র তথ্য মতে, চীন বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৯ লাখ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো সবগুলো পৌঁছে দিতে পারেনি।

চীন ও ভারত— উভয় দেশই প্রতিবেশী মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ভ্যাকসিন পাঠানো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মিয়ামারে প্রায় ৩ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বেইজিং। এখনো এর সরবরাহ শুরু করতে পারেনি। অন্যদিকে, নয়াদিল্লি মিয়ানমারে ১৪ লাখ ডোজ সরবরাহ করেছে।

ভারতের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিষয়টা ঠিক এমন নয় যে ভারতের নিজ দেশে ভ্যাকসিনের প্রয়োজন নেই। ভারতের লোকসংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি। সেখানে করোনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

নয়াদিল্লি জানিয়েছে, ভারত ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তার নিজের জনগণকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তবে ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে ভারতের দক্ষতা থাকায় নিজের নাগরিকদের পাশাপাশি অন্যদেশের চাহিদাও পূরণ করতে পারছে।

ফলে, দেশটির নেতারা এই লাখ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন প্রতিবেশীদের মন জয় করতে ও আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করতে পারছেন।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে সংগ্রহ করা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করা হয়েছে।

ব্লুমবার্গ আরও জানিয়েছে, ভারতের টিকা নিয়ে শুরুতে বাংলাদেশে অনাগ্রহ দেখা গেলেও এখন অনেকেই ভ্যাকসিন নিচ্ছেন। বাংলাদেশে ভারতের ভ্যাকসিন কর্মসূচি স্বতঃস্ফুর্তভাবে চললেও সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এখনো ভ্যাকসিন কর্মসূচি তেমন ইতিবাচকভাবে শুরু হয়নি।

ভারতীয় কর্মকর্তাদের মতে, ভারতের ভ্যাকসিন উত্পাদকরা ধনী দেশগুলোতেও স্বাধীনভাবে চড়া দামে ভ্যাকসিন বিক্রি করতে পারতো। তবে ভারত সরকার তাদের কাছ থেকে ভ্যাকসিন কিনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ছোট দেশগুলোর পাশাপাশি ভারতের নাগরিকদের জন্য ভ্যাকসিন কিনতে সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে।

এছাড়াও, পুনে ও হায়দ্রাবাদে ওষুধ কেন্দ্রগুলো পরিদর্শনের জন্য বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সফরের আয়োজন করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে ভ্যাকসিনের প্রতি অন্য দেশের প্রতিনিধিদের আস্থা বেড়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ এমনকি দূরবর্তী ডোমিনিকান ও বার্বাডোসকেও ভারত সাশ্রয়ী মূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছে। প্রাথমিক শিপমেন্ট বিনামূল্যে হওয়ার কথাও জানিয়েছে।

এমনকি, চীনের সীমান্তেও ভারতীয় ভ্যাকসিন পৌঁছে গেছে। ভারতের সরবরাহ করা দেড় লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বিনামূল্যে পেয়েছে মঙ্গোলিয়া।

অন্যদিকে, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোডো ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান চীনা ভ্যাকসিন নিয়েছেন। ভারতের চির প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ পাকিস্তানেরও ভরসা চীনা ভ্যাকসিন। পাকিস্তানের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য চীন প্রায় ৭০০ কোটি ডলার অর্থায়ন করেছে।

সংবাদ প্রতিবেদন মতে, ভারত ও চীনে উত্পাদিত সব ভ্যাকসিনই ফাইজার ও মডার্নার ভ্যাকসিনগুলোর তুলনায় কম কার্যকর হওয়ায় অনেকেই সেগুলোর ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

ভারত বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ‘কোভিশিল্ড’ সরবরাহ করছে এবং ক্লিনিকাল ট্রায়ালের জন্য ভারত বায়োটেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নিজস্ব ‘কোভ্যাক্সিন’ ডোজ রপ্তানি করছে। ‘কোভ্যাক্সিন’ নিয়ন্ত্রকদের অনুমোদন পেলেই এর চাহিদা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, চীনের সিনোফার্ম গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড, সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেড, ক্যানসিনো বায়োলজিকস ও চংকিং ঝিফেইই বায়োলজিকাল প্রোডাক্টস কোম্পানির উৎপাদিত ভ্যাকসিনগুলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক ও ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য সরবরাহ করা হয়েছে। অন্যান্য এক ডজনেরও বেশি দেশকে ভ্যাকসিন সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন।

প্রতিবেদন মতে, ভারত এ পর্যন্ত মোট ৩ কোটি ৩০ লাখের বেশি ডোজ রপ্তানি করেছে। যা নিজ দেশে দেওয়া ডোজের তিনগুণেরও বেশি। ভারতের টিকা কর্মসূচির ধীরগতি নিয়ে অনেকেই এর সমালোচনা করছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার ভ্যাকসিন কর্মসূচি ত্বরান্বিত করতে বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতেও ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করেছে।

Comments

The Daily Star  | English
Indian Padma Vibhushan industrialist Ratan Tata dies at 86

Ratan Tata passes away

India’s top industrialist and Tata Sons Chairman Emeritus Ratan Tata died in a hospital in Mumbai last night, the company said.

3h ago