‘সাংবিধানিকভাবে বিচার বিভাগ স্বাধীন, কিন্তু বাস্তবে কতটুকু, তা আমরা সকলেই জানি’

সুবিচারের প্রতীক শ্বেতশুভ্র অট্টালিকাটির গায়ে যেন কালিমা না লাগে- এই অনুরোধ রেখেই অবসরে গেলেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
স্টার ফাইল ফটো

সুবিচারের প্রতীক শ্বেতশুভ্র অট্টালিকাটির গায়ে যেন কালিমা না লাগে- এই অনুরোধ রেখেই অবসরে গেলেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। 

দেশের সংবিধান অনুযায়ী, নির্ধারিত বয়স পূর্ণ হওয়ায় বিচারিক দায়িত্ব থেকে অবসরে যাওয়া এই বিচারপতিকে আজ রোববার বিদায় সম্ভাষণ জানানো হয়। 

অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষে সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দারকে বিদায় সম্ভাষণ জানান। ভার্চুয়াল বিদায় সম্ভাষণে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতি ও আইনজীবীরাও যুক্ত ছিলেন।

বিদায় বেলায় নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন শাস্ত্রে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করতে শ্বেতশুভ্র ভবনটিতে প্রবেশ করি। সেই থেকে এই ভবনটিকে আমি আমার দ্বিতীয় বাড়ি হিসেবে গ্রহণ করে নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা, এমনকি রাত পর্যন্ত এখানে কাজের মধ্যে সময় কেটেছে। একপর্যায়ে ২২ বছরের ওকালতি জীবনের ইতি টেনে ২০০১ সালে বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করি। সেদিন থেকেই আমার জীনের মোড়টা ঘুরে যায়। সেদিন থেকেই মনে হয়- সত্য যে কঠিন, সে কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’

দেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি সবার যৌথ প্রয়াসেই বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা আরও পরিণত ও উন্নত হবে। সমষ্টিগত প্রয়াস ও প্রচেষ্টাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। তাই বিচারক থেকে শুরু করে বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলকে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে। সুবিচার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে বিচারালয়ের সর্বনিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে সর্বোচ্চ পদাধিকারীর ঐক্যবদ্ধ থাকা একান্ত প্রয়োজন।’

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বলেন, ‘সাংবিধানিকভাবে বিচার বিভাগ স্বাধীন। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু, তা আমরা সকলেই জানি এবং বুঝি। রাষ্ট্রের তিনটি (নির্বাহী, আইন ও বিচার) বিভাগের চৌহদ্দি সংবিধানে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যেখানে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে থাকার নির্দেশনাও আছে। নিজ নিজ পরিধির মধ্যে থেকে কে কতটুকু কাজ করবে তা সংবিধানে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, যাতে কেউ রেখা অতিক্রম করতে না পারে।’

 এই বিচারপতি বলেন, ‘বিচার ব্যবস্থা তার নিজস্ব গতিতেই চলে। শত চেষ্টা চালিয়েও কেউ তার গতি রোধ করতে পারে না, পারবে না। যত বাধা-বিপত্তি কিংবা ঘাত-প্রতিঘাতই আসুক না কেন, আমাদের ঐকান্তিক ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় বিচার বিভাগের গতি কেউ রোধ করতে পারবে না।’

আইনের তত্ত্ব, তথ্য ও উপাত্ত পরিষ্কারভাবে না যেনে আদালতের রায়কে কেউ যেন বিতর্কিত না করেন সে আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় বিচার বিভাগ প্রদত্ত আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে বিচারক ও বিচার ব্যবস্থাকে এক করে ফেলা হয়। আমরা ভুলে যাই যে, বিচারকও একজন মানুষ।’

সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বলেন, ‘সুবিচারের প্রতীক শ্বেতশুভ্র অট্টালিকাটির গায়ে কোনো কালিমা লাগে- এমন কিছু যেন আমরা না করি।’

বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ১৯৫৪ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগ থেকে এলএলবি ও এলএলএম ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৭৯ সালে জেলা আদালত, ১৯৮১ সালে হাইকোর্ট বিভাগ ও ১৯৯৯ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০০১ সালের ৩ জুলাই তিনি হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি এবং ২০০৩ সালের ৩ জুলাই স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের বিচারপতি হন মির্জা হোসেইন হায়দার। সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে তিনি অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, ভুটান, চীন, ফ্রান্স, ভারত, মালয়েশিয়া, নেপাল, ফিলিপাইন, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও উজবেকিস্তান সফর করেছেন।

Comments

The Daily Star  | English
‘No rule of game’ in collecting remittance

Remittance inflow climbs 21% in November

Migrant workers sent home $1.93 billion in November this year, which was $1.59 billion in the same month last year.

55m ago